গল্পটি পড়লে ভাল লাগবে :-
একটা হাতি মরার পর যমালয়ে গেছে ।
যমরাজ তাকে শুধোচ্ছেন , ‘ হ্যা রে ! তোকে এত বড় একটা প্ৰকাণ্ড শরীর দিয়ে পাঠানো হল , আর তুই মানুষের বশ হলি কী করে ? তোর একটা পায়ের সমান মানুষ , সেই ছোট্ট মানুষটা তোকে বশ করে নিল ? ”
হাতি বলল , “ মহারাজ ! মানুষ এমনই এক জাত যে আমার চেয়েও বড় বড় প্ৰাণীকে সে বশ করে নেয় । ”
ধৰ্মরাজ বলেন , “ আমার এখানে তো কতই না মানুষ আসে । কই , তাদের দেখে তো এমন মনে হয় না । ”
হাতি বলল , “ মহারাজ ! আপনার এখানে তো তারা আসে মরার পরে । যদি জীবন্ত মানুষ আসত তো বুঝতে পারতেন । ”
ধৰ্মরাজ দূতকে বললেন , “ যা তো , একজন জীবন্ত মানুষ এখানে নিয়ে অায় । যমদূত বলল , “ জী হুজুর এখনি যাচ্ছি । ”
দূত পৃথিবীতে বিচরণ করতে করতে এক জায়গায় দেখল , গরমে ছাদের উপরে খাটে একটা লোক ঘুমাচ্ছে । সে তখন খাট সমেত লোকটাকে কঁধে তুলে নিয়ে যমালয়ের দিকে রওনা হল । মাঝপথে লোকটাের ঘুম ভেঙে গেল । দেখল , “ অদ্ভুত ব্যাপার । কেউতাকে শূন্যে তুলেনিয়ে যাচ্ছে ? ”
লোকটাছিল এক কায়স্থ , বইটই লিখত । বইতে যমদূতের যে সকল লক্ষণ লেখা আছে , সেইরকম দেখে সে বুঝল , এ নির্থাৎ যমদূত । আমাকে তাহলে যমালয়ে নিয়ে যাচ্ছে । সে তখন পকেট থেকে তাড়াতাড়ি কাগজ – কলম বার করে খচখচ করে কী সব লিখেই কাগজটা পকেট পুরে নিল । তারপর চুপচাপ খাটের উপর মটকা মেরে পড়ে রইল । ভাবল চিৎকার – চেঁচামেচি করলে পড়ে গিয়ে হাড়গোড় ভাঙবে । দেখা যাক কী হয় । সকাল হতে না হতেই দূত যমালয়ে পৌছে গেল । ধৰ্মরাজের সভা সবে মাত্ৰ আরম্ভ হয়েছে । দূত গিয়ে সেখানে খাট নামাল । কায়স্থ ঝট করে উঠেই পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে দূতের হতে দিল ধৰ্মরাজকে দেবার জন্য । সেই চিরকুট ভগবান বিষ্ণুর নামে লেখা হয়েছিল । দূত কাগজটি ধৰ্মরাজের হাতে দিলে ধৰ্মরাজ সেটি মন দিয়ে পড়লেন ।
তাতে লেখাছিল — “ প্রিয় ধৰ্মরাজ ! আপনাকে জানানো হচ্ছে যে এই পত্ৰবাহক আমার একান্ত – সচিব । একে আপনার কাছে পাঠালাম । একে দিয়ে আপনি যাবতীয় কাজ করাবেন । ইতি নারায়ণ , বৈকুণ্ঠপুরী । ”
লেখা পড়েই ধৰ্মরাজ তড়াক করে গদি থেকে উঠে এসে কায়স্থকে বললেন,
“আসুন মহারাজ ! সিংহাসনে বসুন । ”
কালবিলম্ব না করে কায়স্থ ধৰ্মরাজের সিংহাসনে গিয়ে বসল । ততক্ষণে দূত একটা লোককে নিয়ে এসে সভায় হাজির করল ।
কায়স্থ বলল , “ এ কে ? ”
দূত জানায় — “ হুজুর । এ একটা ডাকাত । বহু লোকের সর্বনাশ করেছে , বহু লোককে খুন করেছে । এর কী দণ্ড হবে ? ” কায়স্থ বলল , “ একে স্বৰ্গে পাঠিয়ে দাও । ”
তারপর আর একজনকে উপস্থিত করা হল । কায়স্থ জিজ্ঞাসা করল , “ এ কে ? দূত বলল — “ এ একজন দুধওয়ালা , দুধে ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করত । সেই ভেজাল দুধ খেয়ে বহু ছোট ছোট শিশু পেট ফুলে মারা গেছে । এর কী শাস্তিবিধান হবে ? ” “ একেও স্বৰ্গে পাঠিয়ে দাও । ”
ততক্ষণে আরেকজন উপস্থিত হল । “ এ কে ? দূত — “ হুজুর এ মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে বহু বেচারিকে ফঁাসিয়েছে । একে কী করব ? ” কায়স্থ – ‘ , জিজ্ঞাসা করছ কী ? সব স্বৰ্গে পাঠিয়ে দাও । ”
এরপর ও ব্যভিচারী , পাপী , হিংসুটে যত রকমের দুষ্ট থাকতে পারে সব একে একে এল , আর সবাইকার জন্য ওই একই হুকুম হল ‘ স্বৰ্গে পাঠিয়ে দাও । ” ধৰ্মরাজ আর কী করবেন ! সিংহাসনে বসে বিষ্ণুর একান্ত সচিব যা বলছেন তাই মেনে নিতে হবে । ওদিকে স্বৰ্গে তো লাইন পড়ে গেছে , দেখে ভগবান ভাবছেন , একি কাণ্ড ! এত লোক কোথা থেকে আসছে ? পৃথিবীতে কী তবে কোনো মহাত্মার আবিৰ্ভাব হল নাকি ? লোকে দল বেঁধে স্বৰ্গে হাজির হচ্ছে । ভগবান দেখলেন , সব যমালয় থেকে উঠে আসছে । নারায়ণ তখন নিজেই যমালয়ে গেলেন । নারায়ণকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল । যমরাজ উঠে দাঁড়ালেন , আর ওই কায়স্থ ও উঠে দাঁড়াল ।
নারায়ণ জিজ্ঞাসা করলেন , ‘ ধৰ্মরাজ ! আপনি সবাইকে স্বৰ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছেন , ব্যাপার
কী ? এত লোক ভক্ত হয়ে গেল নাকি ? ”
ধৰ্মরাজ বললেন , ‘ প্ৰভু ! এ কাজ আমি করিনি । আপনি যে লোক পাঠিয়েছেন , এ তারই কাজ । ”
ভগবান নায়ায়ণ বললেন , “ আমি আবার কবে লোক পাঠালাম ? ”
তিনি কায়স্থকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমাকে কে পাঠিয়েছে ? ”
কায়স্থ বলল , “ প্ৰভু ! আপনি পাঠিয়েছেন । ”
ভগবান নারায়ণ অবাক হয়ে বললেন , “ আমি কবে পাঠালাম হে ? ”
কায়স্থ বলল , “ প্ৰভু ! এখানে আসা আমার বাপের সাধ্য কী যে আসব । আপনিই তো আমাকে পাঠিয়েছেন । আপনার ইচ্ছা ছাড়া কি কোনো কাজ হতে পারে ? এ কি আমার শক্তিতে হয়েছে ? ”
নারায়ণ বললেন , “তা ঠিক আছে ! কিন্তু তুমি এ কী করছ ? ”
কায়স্থ বলল , “ কী করেছি প্ৰভু ? ”
নারায়ণ বললেন , “ তুমি যে সবাইকে স্বৰ্গে পাঠিয়ে দিয়েছ ? ”
কায়স্থ বলল , “ যদি স্বৰ্গে পাঠানো অন্যায় হয়ে থাকে তবে যত সাধু , সন্ত , মহাত্মা আছে সবাইকেই দণ্ড দিতে হয় । আর যদি আমি ঠিক করে থাকি , তবে আর কৈফিয়ৎ কিসের ? এতে যদি আপনার মত না থাকে তো সবাইকে ফেরত পাঠিয়ে দিন ।
তবে শ্ৰীমদ্ভগবদগীতায় আপনার যে বাণী লেখা আছে তা কেটে ফেলতে হবে — “ যদ গত্বা ন নিবৰ্তন্তে তদধাম পরমং মম ’ ( গীতা ১৫ । ৬ ) ”অর্থাৎ আমার ধামে পৌছে কেউ ফিরে আসে না । ”
নারায়ণ — ‘ কথা তো ঠিক ! যত বড়ই পাপী হোক না কেন যদি স্বৰ্গে অর্থাৎ বৈকুণ্ঠধাম যায় তবে ফিরে আসেন না। তার সমস্ত পাপক্ষয় হয়ে যায় । কিন্তু এ কাজ তুমি কেন করলে ? ”
কায়স্থ বলল , “ আমি তো ঠিক কাজই করেছি প্ৰভু ? আমার কাছে যে আসবে আমি তাকেই স্বৰ্গে পাঠিয়ে দেব । আমি কাউকে দণ্ড দেব না । আমি জানি , অল্প সময়ের জন্য সিংহাসন পেয়েছি , তো ভালো কাজ কেন করব না ? মানুষকে উদ্ধার করাকি খারাপ কাজ ?
নারায়ণ যমরাজকে বললেন , ‘ ধৰ্মরাজ ! আমি বুঝতে পারছিনা , একে আপনি সিংহাসনে বসালেন কী কারণে ? ’
ধৰ্মরাজ বললেন , ‘ প্ৰভু ! আপনার লেখা চিরকুট আমার কাছে রয়েছে । ওতে আপনি স্পষ্ট করে এই নিৰ্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন । ”
ভগবান কায়স্থকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ ওহে , তোমাকে আবার চিরকুট দিয়ে কখন পাঠালাম আমি ? ’ কায়স্থ বলল , “ আপনি শ্ৰীমদ্ভগবদগীতায় বলেছেন ”সর্বস্য চাহং হৃদিসন্নিবিষ্টং” ( গীতা ১৫/৭ ) ”আমি সকলের হৃদয়ে বাস করি”। অতএব হৃদয় থেকে আদেশ এসেছে কাগজে লিখে দাও , তাই কাগজে লিখে দিয়েছি । আদেশ তো আপনারই । যদি এটা আপনি আমার কথা মনে করেন তো গীতা থেকে ওই কথাগুলো বাদ দিয়ে দিন । ”
নারায়ণ বললেন , “ ঠিক কথা । ”
তিনি ধৰ্মরাজকে প্রশ্ন করলেন , “ ওহে ধৰ্মরাজ ! ব্যাপার কী ? এই জীবন্ত মানুষ এখানে এল কী করে ? ”
ধৰ্মরাজ দূতকে জিজ্ঞাসা করলেন , ‘ যমালয়ে জীবন্ত মানুষ নিয়ে এলি কেন ? ’ দূত বলল , ‘ ধৰ্মরাজ ! আপনিই তো একদিন বলেছিলেন একটা জীবন্ত মানুষ নিয়ে আসার জন্য । ”
ধৰ্মরাজ বললেন , “ এই সেই লোক নাকি ? আরে , সবকিছু বলবি তো !
দূত বলল , “ আমি কী বলব মহারাজ । আপনিই তো কাগজটা নিলেন আর একে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন । তাই আমি আর কিছু বলার সাহস পাইনি । ”
হাতিটা কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল ।
সে যমরাজকে বলল , “ হুজুর , আপনি বলেছিলেন আমি কী করে মানুষের বশ হলাম ; এখন দেখছি আপনি এবং নারায়ণও স্বয়ং মানুষের বশ হয়ে গেছেন । এই কালো চুলওয়ালা মানুষ খুব সাংঘাতিক মহারাজ ! এ যদি মনে করে সব ওলোট – পালট করে দিতে পারে । কিন্তু এ তো নিজেই সংসারে ফেঁসে আছে । ”
ভগবান বললেন , “ এখন যা হবার হয়ে গেছে , কী আর করা যাবে ! বাবা ! তুমি এবারে ফিরে যাও । ”
কায়স্থ বলল , “ প্ৰভু গীতায় আপনি বলেছেন , “ মামুপেত্য তু কৌন্তেয় পুনৰ্জন্ম ন বিদ্যতে ‘ ( গীতা ৮ । ১৬ ) ”আমাকে পাবার পর পুনরায় আর জন্ম নিতে হয়না , তা এখন বলুন আপনাকে কী আমি পাইনি ? ”
ভগবান বললেন , “ আচ্ছা বাবা ! তুমি চলো আমার সঙ্গে । ”
কায়স্থ বলল , “ প্ৰভু ! কেবল আমিই যাব ? ওই হাতি বেচারা এখানেই থাকবে ? এর কৃপাতেই তো আমি এখানে এসেছি । একেও তাহলে সঙ্গে নিই , প্ৰভু । হাতি বলল , “ প্ৰভু ! আমার অনেক স্বজাতি এখানে নরক ভোগ করছে , তাদেরও তবে সঙ্গে নিয়ে নিন । ’ ভগবান নারায়ণ বললেন — “ চল বাবা , সবাইকেই নিয়ে চল । ”
যমালয়ে ভগবানের আসার ফলে হাতির মঙ্গল হল , কায়স্থেরও মঙ্গল হল অন্য সকলেরও মঙ্গল হল ।
এটি কল্পিত গল্প । কিন্তু এর তাৎপৰ্য খুব গভীর অৰ্থবহ । কোনো অধিকার যদি পাও তবে তা দিয়ে সকলের মঙ্গল করো । যতটা পার ভালো করো । নিজের দিক থেকে কারো কোনো মন্দ করো না , কাউকে দুঃখ দিও না ।
গীতার বাণী ”সৰ্বভূতহিতে রতাঃ” ( গীতা ৫ । ২৫ , ১২ । ৪ )
“অর্থাৎ জীব মাত্রেরই মঙ্গল চিন্তা করো ’ । অধীকার , পদ ইত্যাদি কিছু দিনের জন্য পাওয়া গেছে , চিরকাল থাকবে না । সুতরাং সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।
(সংগৃহীত)
COLLECTED FROM WHAT’SAPP
PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN