আদিশক্তি

Spread the love

ধূমাবতী —

ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার সপ্তম মহাবিদ্যা। শাস্ত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার রাত্রিকে দারুণরাত্রি বলা হয় এবং মহাবিদ্যা ধূমাবতীর আবির্ভাবতিথি রূপে গণ্য করা হয়।

মা ধূমাবতী কেতুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নিষ্ঠাপূর্বক সাধনায় তিনি বিপুল সুফলদায়িনী। মা ধূমাবতীর কৃপালাভ করতে পারলে সাধক সফলতার শিখরে পৌঁছে যায়।

দশমহাবিদ‍্যা দেবীদের মধ্যে সপ্তমরূপ হলো মা ধূমাবতী। আদ‍্যাশক্তির এই রূপের নেপথ্যেও আছে হরগৌরীর দাম্পত‍্যকলহ।

মহাদেব আপনভোলা। তিনি সংসারযাপন করেন অথচ সংসারের কর্মে তার অন‍্যমনস্কতা প্রকট। সংসারের কোনো খেয়াল তার নেই। সে অনন্ত ধ‍্যানে মগ্ন। এদিকে কৈলাসের রন্ধনশালায় যে খাদ‍্যসংকট দেখা দিয়েছে, তা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। মহাদেবের এই নিয়ে কিছুমাত্র ভাবনাও নেই কারণ তিনি জানেন পার্বতী যে অন্নপূর্ণা, তার হেঁশেল শূণ্য হতে পারেনা। কিন্তু পার্বতী যে মহামায়াও, তা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন।

পার্বতী সে বিস্মৃতির প্রতিকার চাইলেন মনে মনে। মহাদেবী বারংবার মহাদেব কে খাদ‍্য আনয়নের অনুরোধ জানান। বারংবার স্বামীকে তার ক্ষুধাগ্নি নির্বাপনের জন্য বলতে লাগলেন। কিন্তু মহেশ্বর তার অনুরোধ কে আমল দিলেননা। তিনি অবিরত থাকলেন তার ধ‍্যানে।

এতো অনুরোধের পরেও স্বামী তার কথায় কর্ণপাত না করায় দেবী ক্রোধান্বিতা হয়ে উঠলেন। দেবীর শরীরের আকৃতি বর্ধিত হতে থাকলো এবং একসময় তা গগনচুম্বী হলো। অতঃপর দেবী ধ‍্যানমগ্ন মহাদেবকে তার বৃহৎ অলক্তচর্চিত অঞ্জলিপুটে ধারণ করলেন এবং স্বয়ং মহাদেবকে ভক্ষণ করলেন।

তৎক্ষণাৎ পার্বতীর বদ্ধবেণী উন্মুক্ত হয়ে তিনি হলেন আলুলায়িতকুন্তলা। পরনের রক্তবস্ত্র বদলে গেল সাদাকাপড়ে। আভরণের জাজ্জ্বল‍্যতা রূপান্তরিত হলো মলিনতায়। পরমতেজস্বী মহাদেবকে ভক্ষণ করার জন্য দেবীর গাত্র থেকে নির্গত হতে থাকলো ধূমরাশি। দেবী হয়ে উঠলেন ধূম্রবর্ণা ধূমাবতী। দেবীর ছায়া সমগ্র চরাচরে এসে পরলো। চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল।

বিশ্বচরাচর কম্পিত হয়ে উঠলো এই কান্ডে। ব্রহ্মাণ্ড স্থির হয়ে গেল। মহাকালের অস্তিত্ব নেই, তাই কাল অর্থাৎ সময় রোহিত হয়ে গেল।

এমতাবস্থায় ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু এলেন দেবীর পাদদেশে এবং করুণ মিনতি জ্ঞাপন করতে থাকলেন, যাতে তিনি পূনরায় পূনর্রূপে প্রত‍্যাবর্তন করেন। ত্রিদেব এবং মহামায়া কালচক্রের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। সময় স্থবির হয়ে গেলেও এনারা তার অধীনস্থ নন।

সময়ের তিনটি পর্যায় — অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সময় থমকে গেলে এই তিনটি পর্যায়ের চলনশক্তি লোপ পায়। আবার মহাদেব এবং মহাদেবীর মিলন ছাড়া ঐ চলনশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করাও অসম্ভব। তাই নিজকর্মে অনুতপ্ত ধূমাবতী ধ‍্যানমগ্না হলেন।

মহাদেবকে ভক্ষণ করা যতোটা প্রাঞ্জল ছিল, তাকে জঠরমুক্ত করা তার কাছে ততোটা প্রাঞ্জল নয়। দেবী ধ‍্যানযোগে মহাদেবেরই স্মরণাপন্ন হলেন। মহাদেবের কাছে ধ‍্যানযোগে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন দেবী।

ধূমাবতীর জহরস্থিত মহাদেব, ধূমাবতীর অনুতাপ কে লঘু করলেন এবং বোঝালেন, তিনি কখনও মহাদেবের পূর্ণধ্বংস করতে পারবেন না। দেবী তার অস্তিত্ব কে কেবল অস্বীকার করেছে মাত্র, তাই তিনি বিধবা, তবে মহাদেব তার মধ্যেই নিহিত আছেন। জন্ম মৃত্যু একটা ভ্রম মাত্র। মহাকাল এবং মহাকালী এই ভ্রমের ঊর্ধ্বে। মহাকাল ও মহাকালী পরস্পরের পরিপূরক। তিনি শিবের ধ্বংস করেননি, পরন্তু শিবের নবজন্ম দিচ্ছেন দেবী।

এরূপ স্তোকবাক‍্যে শান্ত হয়ে দেবী তার জঠরের সকল শক্তি কে ঊর্ধগামী করলেন। সেই ঊর্ধগামী স্রোতে আবির্ভূত হলেন দেবাদিদেব মহাদেব।

ভগবান শঙ্কর দেবী পার্বতীকে বললেন —
তোমার সুন্দর চেহারাখানা ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়ায় তোমাকে ধূমাবতী বা ধূম্রা বলে ডাকা হবে।

ধূমাবতী দীর্ঘকায়া। লম্বিত কুচদ্বয়শোভিতা। ভীষণ দন্তরাশিযুক্ত মুখমণ্ডল ভয়াবহ। ধুম্রবর্ণা কুটিলনয়না সর্বদা ক্ষুধাতুরা শীর্ণকায়া দেবী ধুম্রাচ্ছন্ন মলিনবসন পরিহিতা অবস্থায় শূর্পহস্তে কাকধ্বজ রথে আসীনা।

দশমহাবিদ্যার মধ্যে একমাত্র তিনিই ভৈরবরহিতা। স্বয়ংসম্পূর্ণা। মা ধূমাবতী মহাশক্তি একলা এবং তিনি স্বয়ং নিয়ন্ত্রিতা। তার কোনও স্বামী বা প্ৰভু নেই। এইজন্য তাকে বিধবাররূপে কল্পনা করা হয়।

দুর্গাসপ্তশতী অনুসারে ইনিই সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে —
“যে আমাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে আমার গর্ব চূৰ্ণ করবে, সেই আমার পতি হবে। সেই প্রতিজ্ঞা কেউ ভাঙ্গতে পারেনি, তাই তিনি কুমারী। ধন বা পতি না থাকাতে অথবা নিজের স্বামী মহাদেবকে গিলে ফেলায় ইনি বিধবা ।

নারদপাঞ্চরাত্র অনুযায়ী ইনি নিজ শরীর থেকে দেবী উগ্ৰচণ্ডিকাকে প্রকাশিত করেছিলেন যিনি শত শত শকুনের মত আওয়াজ করতেন। শিবকে গিলে ফেলার অর্থ হল তার স্বামীত্বকে অস্বীকার। অসুরদের কাঁচামাংসে তার অঙ্গভূত শৃগালেরা তৃপ্ত হল, এটাই হল এর ক্ষুধার তত্ত্ব।

ধোঁয়ারূপে ইনি বিবর্ণা, চঞ্চলা, কৃষ্ণবর্ণা, অপরিচ্ছন্ন বস্ত্রপরিহিতা, মুক্তকেশী, বিধবা, কাকধ্বজ চিহ্নিত রথারূঢ়া, হাতে কুলা, ক্ষুধাপিপাসায় ব্যাকুল মুখ, চােখ দুটি নির্মম দৃষ্টিদায়িনী।

স্বতন্ত্রতন্ত্র অনুসারে সতীদেবী যখন দক্ষযজ্ঞে যোগাগ্নিতে নিজেকে ভস্মীভূত করেছিলেন, তখন সেই অগ্নি থেকে যে ধোঁয়া বেরিয়েছিল তার থেকেই ধূমাবতী বিগ্রহ প্রকট হয়েছিলেন।

দেবীধূমাবতীর উপাসনা — বিপদনাশ, রোগমুক্তি, যুদ্ধজয়, উচাটন ও মারণাদি কর্মে সিদ্ধিলাভ এর জন্য করা হয়।

শাক্তপ্রমোদে বর্ণনা আছে যে এর উপাসকের উপর অশুভ, ক্ষতিকর ক্রিয়ার কোনও প্রভাব পড়েনা।

সব রোগ, দুঃখের অধিপতি হচ্ছেন চার দেবতা। জ্বর, উন্মাদ ও প্রদাহ হয় রূদ্রেরকোপে, মূর্চ্ছা, বিকলাঙ্গতা যমের কোপে, ধূলি (ধূসরতা-রূক্ষ- কৰ্কশতা) গ্রন্থিরোগ (গাটঁফোলা) শক্তিলোপ বা কোন অঙ্গ অবশ হয়ে যাওয়া-পক্ষাঘাত এবং শোক, কলহ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি নির্ধতির কোপের দরুন হয়।

শতপথব্রাহ্মন অনুসারে ধূমাবতী ও নির্ধতি একই। ইনি লক্ষ্মীর জ্যেষ্ঠা, তাই জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে জন্মান মানুষ আজীবন দুঃখভোগ করে।

তন্ত্রগ্রন্থ অনুসারে ধূমাবতী আর উগ্ৰতারা একই, ধূম্রা হওয়ার জন্য ধূমাবতী নাম।

শ্ৰীশ্ৰীচণ্ডীতে বাভ্রবী ও তামসী নামে এর ব্যাখা আছে। ইনি তুষ্ট হলে রোগ এবং শোক নাশ করেন আর কুপিত হলে সমস্ত সুখ ঐশ্বর্য এবং ঈপ্সিত বস্তু নষ্ট করে দেন। এর শরনাগতি নিলে বিপত্তিনাশ এবং সম্পত্তি প্রাপ্তি হয়।

ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তে একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুতরা’। সুতরার অর্থ সুখপূর্বক তারণের উপযুক্ত। তাঁরা বা তারিনী এর পূৰ্বরূপ বলে মনে করা হয়। এইজন্য আগমশাস্ত্ৰে অভাব, সঙ্কটনাশ করে সুখদায়িনী বিভূতিরূপে ইনি।

ধূমাবতীর স্তব বন্দনা —

ঠং ঠং ঠং ঠং মনুপ্রীতিং ঠঃ ঠঃ মন্ত্রস্বরূপিণীম্ ।

থাং থীং থূং থেং মন্ত্ররূপাং থৈং থৌং থং থঃ স্বরূপিণীম্ ।

টণ্টণ্টণ্টণ্টটণ্টাণ্রকটটমটমা নাটঘণ্টাং বহন্তী ।

স্তব অনুযায়ী দেবী ধূমাবতী নাট্যনর্ত্তনাদি ললিতকলার এক অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

নর্ত্তকীনটনপ্রীতাং নাট্যকর্মবিবর্দ্ধিনীম্ ।

আবার স্তবমন্ত্রে
“ফেত্কারিগণসংসেব্যাং সেবে ধূমাবতীমহম্” থেকে জানা যায় দেবী ধূমাবতী ফেৎকারীগণের দ্বারা সেবিতা।

মাতৃবন্দনার আদিপর্বের সেই ধূসর অতীতেরই সংসর্গ আছে দেবী ধূমাবতীর মধ্যে।

লোলম্মুণ্ডাগ্রমালা ললহলহলহা লোললোলাগ্রবাচং চর্বন্তীচণ্ডমুণ্ডং মটমটমটিতে চর্যষন্তী পুনাতু ॥

অর্থাৎ, ধূমাবতী চণ্ডমুণ্ডের অস্থি মটমট করে চর্বণ করেন।

ধূমাবতী মাতৃকা উপাসকদের কাছে সেই বিপদহারিণী মাতৃকা; যিনি একাধারে শত্রুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা ক্রূরকুটিলা ভীষণা আবার স্বভূমির ললিতকলার প্রধান রক্ষয়িত্রী।

মা ধূমাবতী প্রণাম মন্ত্র —

ॐ বিবর্ণা চঞ্চলা রুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা ।
বিব‍র্ণাকুন্তলা রুক্ষা বিধবা বিরলদ্বিজা ॥

.

জয় মা

.

(সংগৃহীত)TAKEN  FROM WHAT’SAPP

Published by SHRUTI ADHYA KUNDU

MARKETING OFFICER OF SYCN


Spread the love