শ্রীরামকৃষ্ণ

“তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌ ৷
শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ ৷৷”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২৫শে জুন

ঈশ্বরলাভের অনন্ত পথ — ভক্তিযোগই যুগধর্ম

শ্রীরামকৃষ্ণ — *দেখ, অমৃত-সাগরে যাবার অনন্ত পথ। যে কোন প্রকারে এ-সাগরে পড়তে পারলেই হল। মনে কর অমৃতের একটি কুণ্ড আছে। কোনরকমে এই অমৃত একটু মুখে পড়লেই অমর হবে; — তা তুমি নিজে ঝাঁপ দিয়েই পড়, বা সিঁড়িতে আস্তে আস্তে নেমে একটু খাও, বা কেউ তোমায় ধাক্কা মেরে ফেলেই দিক। একই ফল। একটু অমৃত আস্বাদন করলেই অমর হবে।*

*“অনন্ত পথ — তার মধ্যে জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি — যে পথ দিয়া যাও, আন্তরিক হলে ঈশ্বরকে পাবে।*

*“মোটামুটি যোগ তিনপ্রকার; জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, আর ভক্তিযোগ।*

*“জ্ঞানযোগ — জ্ঞানী, ব্রহ্মকে জানতে চায়; নেতি নেতি বিচার করে। ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা — এই বিচার করে। সদসৎ বিচার করে। বিচারের শেষ যেখানে, সেখানে সমাধি হয়, আর ব্রহ্মজ্ঞানলাভ হয়।*

*“কর্মযোগ — কর্ম দ্বারা ঈশ্বরে মন রাখা। তুমি যা শিখাচ্ছ। অনাসক্ত হয়ে প্রাণায়াম, ধ্যানধারণাদি কর্মযোগ। সংসারী লোকেরা যদি অনাসক্ত হয়ে ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে, তাতে ভক্তি রেখে, সংসারের কর্ম করে, সেও কর্মযোগ। ঈশ্বরে ফল সমর্পণ করে পূজা জপাদি করার নামও কর্মযোগ। ঈশ্বরলাভই কর্মযোগের উদ্দেশ্য।*

*“ভক্তিযোগ — ঈশ্বরের নামগুণকীর্তন এই সব করে তাঁতে মন রাখা। কলিযুগের পক্ষে ভক্তিযোগ সহজ পথ। ভক্তিযোগই যুগধর্ম।*

*“কর্মযোগ বড় কঠিন — প্রথমতঃ, আগেই বলেছি, সময় কই? শাস্ত্রে যে-সব কর্ম করতে বলেছে, তার সময় কি? কলিতে আয়ু কম। তারপর অনাসক্ত হয়ে, ফল কামনা না করে, কর্ম করা ভারী কঠিন। ঈশ্বরলাভ না করলে অনাসক্ত হওয়া যায় না। তুমি হয়তো জান না, কিন্তু কোথা থেকে আসক্তি এসে পড়ে।*

*“জ্ঞানযোগও — এ-যুগে ভারী কঠিন। জীবের একে অন্নগত প্রাণ; তাতে আয়ু কম। আবার দেহবুদ্ধি কোন মতে যায় না। এদিকে দেহবুদ্ধি না গেলে একেবারে জ্ঞানই হবে না। জ্ঞানী বলে, আমি সেই ব্রহ্ম; আমি শরীর নই, আমি ক্ষুধা, তৃষ্ণা, রোগ, শোক, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ — এ-সকলের পার। যদি রোগ, শোক, সুখ দুঃখ — এ-সব বোধ থাকে, তুমি জ্ঞানী কেমন করে হবে? এদিকে কাঁটায় হাত কেটে যাচ্ছে, দরদর করে রক্ত পড়ছে, খুব লাগছে — অথচ বলছে, কই হাত তো কাটে নাই। আমার কি হয়েছে?”*

[জ্ঞানযোগ বা কর্মযোগ যুগধর্ম নহে ]

*“তাই এ যুগের পক্ষে ভক্তিযোগ। এতে অন্যান্য পথের চেয়ে সহজে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়। জ্ঞানযোগ বা কর্মযোগ আর অন্যান্য পথ দিয়েও ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এ-সব ভারী কঠিন।*

*“ভক্তিযোগ যুগধর্ম — তার এ-মানে নয় যে, ভক্ত এক জায়গায় যাবে, জ্ঞানী বা কর্মী আর এক জায়গায় যাবে। এর মানে যিনি ব্রহ্ম জ্ঞান চান, তিনি যদি ভক্তিপথ ধরেও যান, তা হলেও সেই জ্ঞানলাভ করবেন। ভক্তবৎসল মনে করলেই ব্রহ্মজ্ঞান দিতে পারেন।”*

[ভক্তের কি ব্রহ্মজ্ঞান হয়? ভক্ত কিরূপ কর্ম ও কি প্রার্থনা করে ]

*“ভক্ত ঈশ্বরের সাকাররূপ দেখতে চায় ও তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চায়; — প্রায় ব্রহ্মজ্ঞান চায় না। তবে ঈশ্বর ইচ্ছাময়, তাঁর যদি খুশি হয় তিনি ভক্তকে সকল ঐশ্বর্যের অধিকারী করেন। ভক্তিও দেন, জ্ঞানও দেন। কলকাতায় যদি কেউ একবার এসে পড়তে পারে তাহলে গড়ের মাঠ, সুসাইটি (Asiatic Society’s Museum) সবই দেখতে পায়।*

*“কথাটা এই, এখন কলকাতায় কেমন করে আসি।*

*“জগতের মাকে পেলে, ভক্তিও পাবে, জ্ঞানও পাবে। জ্ঞানও পাবে, ভক্তিও পাবে। ভাবসমাধিতে রূপদর্শন, নির্বিকল্পসমাধিতে অখণ্ডসচ্চিদানন্দ-দর্শন হয়, তখন অহং, নাম, রূপ থাকে না।*

*“ভক্ত বলে, মা, সকাম কর্মে আমার বড় ভয় হয়। সে কর্মে কামনা আছে। সে কর্ম করলেই ফল পেতে হবে। আবার অনাসক্ত হয়ে কর্ম করা কঠিন। সকাম কর্ম করতে গেলে, তোমায় ভুলে যাব। তবে এমন কর্মে কাজ নাই। যতদিন না তোমায় লাভ করতে পারি, ততদিন পর্যন্ত যেন কর্ম কমে যায়। যেটুকু কর্ম থাকবে, সেটুকু কর্ম যেন অনাসক্ত হয়ে করতে পারি, আর সঙ্গে সঙ্গে যেন খুব ভক্তি হয়। আর যতদিন না তোমায় লাভ করতে পারি, ততদিন কোন নূতন কর্ম জড়াতে মন না যায়। তবে তুমি যখন আদেশ করবে তখন তোমার কর্ম করব। নচেৎ নয়।”*

“ওঁ নিরঞ্জনং নিত্যমনন্তরূপং ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ।
ঈশাবতারং পরমেশমীড্যং তং রামকৃষ্ণং শিরসা নমামি।।”

TAKEN FROM FACEBOOK, PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN🙏🏻

শ্রীরামকৃষ্ণের কথোপকথন

পুজো কি? খেয়ে দেয় কি পুজো করা যায়?

নির্ধারিত সময় ধরে উপোস না করে পুজো দিলে সে পুজোর কি সার্থকতা নেই?

এ সকল প্রশ্ন কিন্তু আমাদের অনেকের মনেই ঘোরা ফেরা করে।

স্বামী অদ্ভুতানন্দ মহারাজ শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ পার্ষদ শিষ্য সন্তান ছিলেন। ঠাকুর প্রসঙ্গে তিনি তাঁর স্মৃতিচারণায় ঠিক এই বিষয়গুলোই আলোচনা করেছিলেন। আসুন শুনে নেওয়া যাক।

 

শ্রী শ্রী ঠাকুর বলতেন,

“পুজো কি জানিস? ” – বলেই শ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন,

“তাঁকে কি দেবো? সবই তো তাঁর। ভালো ভালো জিনিস যা দিবি তাঁর ছাড়া তো কারুর নয়। ”

এরপর শ্রী শ্রী ঠাকুর একটি অসাধারণ গল্প বললেন।

“একবার একজন বড়লোক তার নিজের বাগানের বৈঠকখানায় গিয়ে বসে আছেন। বাগানের মালী টালি সব বাগানের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। এমন সময় দারোয়ান এসে বললে, ‘বাবু, আমি আপনার জন্য কাল থেকে একটা গাছ পাকা পেঁপে তুলে রেখে দিয়েছি। আপনি এটা নিন বাবু’। বাবু কিন্তু জানেন, বাগান তাঁর, গাছও তাঁর, পেঁপেও তাঁর। কিন্তু ওই যে দারোয়ান কত শ্রদ্ধা করে মনে করে পেঁপেটি তার বাবুর জন্য রেখে তাঁকে দিলো, এটা কি বাবু দেখবেন না? দারোয়ানের শ্রদ্ধা কি বাবুর মন কে বিগলিত করবে না? বুঝবি পুজো করাও ঠিক সেই রকম।”

এর পরেই শ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন,

” কিছু খেয়ে দেয় পুজো করলে কোন দোষ নেই। পেট খিদেয় চুঁই চুঁই করলে পুজো করবে কেমন করে? কেবল খাবারের দিকেই তো মন পরে থাকবে। কিছু খেয়েদেয় তারপর পুজোয় বসলে মন স্থির হয়।”

 

এই জন্যই ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন মন মুখ এক করে ভক্তি করতে হয়। লোক দেখানো ভক্তিতে কোন ফল হয় না। ওসব পাটোয়ারী বুদ্ধি। লোক দেখানো ভক্তিভাব বেশিদিন থাকে না। সময় মতন স্বরূপ ঠিক বেরিয়ে পরে। তাই যা করবে মন থেকে করবে, রীতি এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে করবে। যে অমনি করবে সে’ই হবে আসল ভক্ত।”

 

সত্যি ভাবলে পরে অবাক হয়ে যেতে হয় এ কথা গুলো কতখানি সত্য আজকের দিনে। অথচ শ্রী শ্রী ঠাকুর সেই কোন কালে বলে গিয়েছেন কথাগুলো। একজন প্রকৃত দার্শনিক পুরুষ না হলে জীবন দর্শন সম্বন্ধে এই মূল্যবান কথাগুলো বলা সম্ভব নয়। ঠিক যেমন ভগবান গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন,

“অনাহারে সাধন মেলে না।”

সুজাতার দান করা পায়েস খেয়ে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন। খালি পেটে যদি ভগবান কে পাওয়া যেত তাহলে দারিদ্রতার অন্ধকারে নিমজ্জিত যে মানুষগুলোর দু বেলা আহার জোটেনা তাঁরাই বোধহয় সবার আগে ঈশ্বর লাভ করতো। তাই নয় কি?

COLLECTED FROM WHAT’S APP 

published by SHRUTI ADHYA KUNDU marketing officer of SYCN