বিশ্বে নানা ধর্মের অনুসারীরা আছেন, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব বিশ্বাস ও অনুশাসন রয়েছে। তবে হিন্দুধর্মের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো—এতে দেব-দেবীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা থেকে শুরু করে লক্ষ্মী, দুর্গা, সরস্বতী এবং আরো অগণিত দেব-দেবী হিন্দু ধর্মে বিদ্যমান। অন্য ধর্মের তুলনায় এত দেব-দেবী কেন—এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর উত্তর পেতে হলে আমাদের হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, দর্শন, সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় মনোভাব বিশ্লেষণ করতে হবে।
হিন্দুধর্মের বহুত্ববাদী স্বভাব:
হিন্দুধর্ম একক কোনো ধর্মগ্রন্থ বা একজন প্রবর্তক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। এটি একটি চিরায়ত জীবনব্যবস্থা, যা হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। এই ধর্মে একাধারে রয়েছে ঐক্য (Advaita) এবং বহুত্ব (Dvaita)—এই দ্বৈত ধারণার সহাবস্থান। এই জন্যই একদিকে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এক, কিন্তু সেই ব্রহ্ম নানা রূপে অবতীর্ণ হতে পারে—এই বিশ্বাস থেকেই বহু দেব-দেবীর ধারণার উদ্ভব।
দর্শনগত ব্যাখ্যা:
হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয়, “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি”, অর্থাৎ “সত্য এক, জ্ঞানীরা তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকেন।” তাই হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের একাধিক রূপ সৃষ্টি হয়েছে, যেমন:
ত্রিমূর্তি ধারণা: ব্রহ্মা (সৃষ্টি), বিষ্ণু (পালন), ও শিব (বিনাশ)
শক্তি আরাধনা: নারীরূপী দেবীর পূজা, যেমন দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী ইত্যাদি
অবতারবাদ: ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন—যেমন রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ইত্যাদি।
এই দর্শন অনুযায়ী, মানুষের মনোবৃত্তি ও চাহিদা অনুযায়ী ঈশ্বরের রূপ পরিবর্তিত হয়।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ:
ভারত একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশ। বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি, উপজাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে সহাবস্থানের ফলে প্রতিটি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব উপাস্য দেবতা তৈরি করেছে। যেমন:
কৃষিজীবী সমাজে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নির পূজা ছিল
শিক্ষা ও জ্ঞানের জন্য সরস্বতী
ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লক্ষ্মী
রোগ নিরাময়ের জন্য ধন্বন্তরি ইত্যাদি
এইভাবে সমাজের নানা প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন দেবতার পূজা জনপ্রিয় হয়েছে।
আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা:
হিন্দুধর্ম একটি উদার ধর্ম। এখানে এমনকি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করাও গ্রহণযোগ্য। চার্বাক দর্শন, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু মতবাদের আশ্রয়ে থেকেই গড়ে উঠেছে। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বহুবিধ চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে এবং প্রতিটি চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন দেবতা বা উপাসনার মাধ্যমে।
মানবিক মনোভাব ও প্রতীকী ব্যাখ্যা:
হিন্দু দেব-দেবীগণ শুধু ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক নন, বরং মানুষের গুণাবলির প্রতিচ্ছবি। যেমন:
সরস্বতী প্রতীক জ্ঞান ও সংগীতের
দুর্গা প্রতীক শক্তি ও সাহসের
বৃদ্ধ হনুমান প্রতীক ভক্তি ও সেবার
এভাবে প্রতিটি দেবতার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়।
অতএব, হিন্দু ধর্মে এত দেব-দেবীর উপস্থিতি শুধু ধর্মীয় নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ও দার্শনিক প্রক্রিয়ার ফল। এটি বহুত্ববাদ, সহনশীলতা এবং উদার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। যদিও অন্য ধর্মগুলোতে একেশ্বরবাদ প্রধান, হিন্দুধর্ম বহু দেবতার মাধ্যমে ঐক্যের পথ দেখায়—সবই এক পরমাত্মার বিভিন্ন রূপ। এই কারণেই হিন্দু ধর্ম এত দেব-দেবীতে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।