সাধকশ্রেষ্ঠ শ্রীবামাক্ষ্যাপার জন্মদিন।
১২৪৪ সালের ১২ই ফাল্গুন, বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশীযুক্তা শিব চতুর্দ্দশী তিথিতে রাত ৩টা ১৫ মিনিট সময়ে বীরভূমের আটলা গ্রামে বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। বামদেবের পিতার নাম সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায়, মায়ের নাম রাজকুমারী দেবী। সর্বানন্দ ও রাজকুমারীর দ্বিতীয় সন্তান বামা।
শিব চতুর্দ্দশী রাত্রিতে মেয়েরা চার প্রহরে চারবার জল ঢালে শিবের মাথায়। চার প্রহরে নাম — ঈশানায়, অঘরায়, বামদেবায় ও সদ্যজাতায়। এই চার প্রহরে চার রকম উপাচার নিয়ে শিবের মাথায় জল ঢালে। যথা দুধ, দই, ঘি ও মধু। রাজকুমারী দেবী সন্তান প্রসব করেছেন চতুর্দ্দশী রাত্রির তৃতীয় প্রহরে অর্থাৎ বামদেব প্রহরে। সর্বানন্দ চট্টোপাধ্যায় তিথি বিশ্লেষণে ছেলের নামকরণের এই একটা দিক পেলেন।
আবার মনে ভাবেন রাজকুমারী প্রথমে কন্যা সন্তান হওয়ার পর পুত্র সন্তান কামনায় মা তারার কাছে কুঠর দিয়েছিলেন। যে মাসে কুঠর দেন সেই মাসেই তার গর্ভে সন্তান আসে। এই তারার অনেক নাম আছে — নীলা, তারা, বামা, উগ্রা মহাগ্রা, একজটা ও নীলসরস্বতী ইত্যাদি।
তারা (বামা) মায়ের আশীর্বাদে ছেলে হয়েছে আর চতুর্দ্দশীর তৃতীয় প্রহরের নাম বামদেব সুতরাং তিনি দু’য়ে মিলিয়ে নামকরণ করলেন ‘বামাচরণ’। তারা মায়ের কাছে হত্যা দিয়ে হয়েছে সুতরাং তিনি নাম রাখলেন তারা মায়ের চরণ।
ছোটো থেকেই ঈশ্বরের প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল বামার। বামা ছোটো থেকেই বাবার সঙ্গে বিভিন্ন মন্দিরে যেতেন। তারাপীঠ মন্দিরেও আসতেন। গাছে উঠে ফল, ফুল পেড়ে তারামায়ের উদ্দেশ্যে “নে মা, নে” বলে ছুঁড়ে দিতেন। খেলতে খেলতে বামা মাঝে মাঝেই দ্বারকা নদী সাঁতরে পার হয়ে তারাপীঠ মন্দিরে চলে আসতেন।
ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে সর্বানন্দের অভাবের সংসার হলেও বাবা বামাকে পাঠশালায় ভর্তি করেন। কিছুদিন পরে অভাবের অনুশাসনে বাবা পড়াশুনা ছাড়িয়ে বামাকে রামায়ণ-মহাভারত ও কীর্তন শেখান, তারপর বামাকে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে চলে যেতেন সেই সব গান পরিবেশন করে কিছু বাড়তি রোজগারেের আশায়। তারাপীঠ মন্দিরে একদিন সংগীত পরিবেশন করার সময়ে বামা সমাধিস্থ হয়ে পড়েন, সেই প্রথমবার শুরু হয়েছিল বামার আত্মদর্শন ও সমাধিস্থ হওয়া।
১২৬২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বামার পিতৃবিয়োগ হয়। কিশোর বামা পড়ে থাকতেন তারাপীঠ মন্দিরে আর শ্মশানে, মুখে একটাই বুলি‚ “জয় তারা”।
এই সময়ে গ্রামে এলেন ব্রজবাসী কৈলাসপতি, কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজে তাঁর স্থান নেই। তিনি তান্ত্রিক পিশাচসিদ্ধ। বামা তাঁর শিষ্যত্ব নিলেন। বেগতিক দেখে ছেলেকে বন্দি করে রাখেন বামার মা। কিন্তু যে করেই হোক‚ তিনি পালান। ছুটে যান গুরুর কাছে বা মন্দিরে। মন্দিরের তারা মাকে ডাকেন বড় মা। নিজের জন্মদাত্রীকে ছোট মা।
পাগল সাধক একদিন তারাপীঠ মন্দিরের পুজারী হলেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে সমস্যার শেষ নেই। পুজোর সময় মানেন না কোনও নিয়ম কানুন বা মন্ত্র তন্ত্র। কখনও মাকে ভক্তি করছেন। কখনও বা মা তারাকে গালি দিচ্ছেন। তাঁর পুজোর সময় চারধারে ভিড় জমত দর্শকদের। সবাই দেখত পুজারীর বামুনের খেয়ালীপনা।
পুজোয় কোনও নিয়ম মানতেন না। সংস্কৃতর বদলে বলতেন নিজের মতো বাংলা মন্ত্র। প্রসাদ আগে নিজে খেয়ে উচ্ছিষ্ট ছুড়ে দিতেন মায়ের বিগ্রহের দিকে। বলতেন‚ মা কখনও সন্তানকে ফেলে আগে খান ? সন্তানের দুষ্টুমিতে রেগে যান ? তাই তো তিনি আগেই প্রসাদ খেয়ে নেন।
চন্দনের বদলে নিজের চোখের জলে ফুল মাখিয়ে নিতেন বামাক্ষ্যাপা। তারপর তা ছুঁড়ে দিতেন মায়ের বিগ্রহের দিকে। আশ্চর্য ! ফুলগুলো ঠিক মালার আকারে সজ্জিত হতো দেবীর গলায়।
সাধনমগ্ন বামা সারাদিন থাকতেন ভাবসমাধিতে বা ঘোরের মধ্যে। একদিন বামদেব মায়ের বিগ্রহে মূত্রই ত্যাগ করে দিলেন। এ নিয়ে হৈ চৈ পড়লো। বামদেব বললেন- “আমি আমার মার কোলে হাগবো মুতবো তাতে কোন শালার কি ?” এমনই ছিলো সন্তান আর মায়ের লীলা।
এটা ভালভাবে নিল না ব্রাহ্মণ সমাজ। এদিকে হামেশাই মায়ের নৈবেদ্য বা প্রসাদ আগে খেয়ে নিতেন সাধক বামা। তারউপর শ্মশানে বসে অজাত কুজাত সবার সঙ্গে সারতেন খাওয়া দাওয়া। একদিন এই অনাচার বন্ধ করতে তাঁকে বেদম প্রহার করলেন ব্রাহ্মণরা।
সে রাতে স্বপ্ন পেলেন নাটোরের রানি। মন্দির ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মা তারা। বলছেন‚ তাঁর ছেলেকে খেতে দেয়নি কেউ। বদলে মেরেছে সবাই। তাই দেবী নিজেও অভুক্ত। তাঁর সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত। কারণ ছেলের প্রহার ধারণ করেছেন নিজ অঙ্গে।
রানিমা এরপর জানতে পারলেন কী হয়েছে। তাঁর নির্দেশে বামা আবার বহাল হলেন পুজারীর কাজে।
তন্ত্রসাধনাকে অন্য মার্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তন্ত্রের জটিল দিকের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল সরল ভক্তিযোগ। অঘোরী সাধুদের মতো মৃতদেহের উপর বসে ধ্যান বা মৃতদেহ থেকে মাংস ভক্ষণ‚ সবই করতেন তিনি। কিন্তু তাতে শিষ্য সংখ্যা ঘাটতি হয়নি। শিষ্যদের যেমন স্নেহ করতেন‚ তেমনি কঠোর ছিলেন। ভণ্ডামি সহ্য করতে পারতেন না। ভাব আর ভক্তিকে এক বিন্দুতে এনে মিলিয়েছিলেন।
১২৭৪ সালের কৌশিকী অমাবস্যা তিথিতে তারাপীঠ মহাশ্মশানের শ্বেতশিমূল বৃক্ষের নীচে সাধক বামদেব সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
গুরু বামদেবের উচ্চারিত মন্ত্রটি হল —
হূং ভগবত্যে একজটায়ৈ বিদ্মহে বিকট
দংষ্ট্রে ধীমাহি তন্যস্তারে প্রচোদয়াৎ।
ॐ তারা ॐ তারা ॐ তারায়ৈ বৌষট।।
বামাক্ষ্যাপা সন্দর্শনে তারাপীঠে গিয়েছিলেন বহু মনীষী। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ব্রাহ্ম হলেও তিনি বামাক্ষ্যাপাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। ১২৭৯ সালে একদিন তিনি গেলেন তারাপীঠে। দুজনার কথা হল কিছুক্ষণ। ফেরার সময় বামাক্ষ্যাপা মহর্ষিকে বলেন, “ফেরার পথে ট্রেন থেকেই দেখতে পাবে একটা বিশাল মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে একটা ছাতিম গাছ আছে। তার নীচে বসে ধ্যান করবে। দেখবে মনের ভিতরে আনন্দের জ্যোতি জ্বলে উঠছে। ওখানে একটা আশ্রম বানাও দেখি। আহা, শান্তি শান্তি।”
ফেরার পথে সেই মাঠ এবং ছাতিম গাছ দেখে তিনি চমৎকৃত হলেন। সেখানে বসে ধ্যানে মগ্নও হলেন। সত্যিই এ এক অলৌকিক আনন্দের স্বাদ পেলেন যেন। তিনি ঠিক করলেন এখানেই তিনি আশ্রম স্থাপন করবেন। সেই স্থানই আজকের শান্তিনিকেতন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একবার চারণকবি মুকুন্দদাসের সঙ্গে তারাপীঠে গিয়ে বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে দেখা করার জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেছিলেন। সন্ধ্যায় বামাক্ষ্যাপার সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়। মুকুন্দদাসেকে দেখে বামাক্ষ্যাপা বলেন, “তোর ফুটুস কলটা নদীতে ফেলে দিয়ে আয়।” উল্লেখ্য, চারণকবির কোমরে গোঁজা ছিল একটা রিভলভার। তারপর তিনি রবীন্দ্রনাথকে বলেন, “তোর খুব নামডাক হবে।” দুজনকে তারামায়ের প্রসাদ খাইয়ে তিনি ছেড়েছিলেন।
১২৮৯ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়েসে বিএ পাঠরত নরেন্দ্রনাথ দত্ত (পরে স্বামী বিবেকানন্দ) সহপাঠী শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীকে নিয়ে আসেন মহাসাধক বামাক্ষ্যাপার দর্শনে। তারাপীঠে তারামাকে দর্শন ও প্রণাম সেরে এলেন মহাশ্মশানের শিমুলতলায়।
দেখা হল দু’জনের। সে এক মহা সন্ধিক্ষণ। বামাক্ষ্যাপা ও নরেন্দ্রনাথ দু’জনেই দু’জনের দিকে দীর্ঘক্ষণ অপলক তাকিয়ে। আনন্দে আপ্লুত দুজনের চোখেই জল।
ক্ষ্যাপাবাবার দর্শন করে তৃপ্ত হলেন নরেন্দ্রনাথ। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বামদেবকে প্রণাম করলেন নরেন্দ্রনাথ। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন ক্ষ্যাপাবাবা।
খানিক পরে শিমুলতলায় ক্ষ্যাপাবাবাকে জিজ্ঞাসা করলেন শরৎ, বাবা আপনি এক দৃষ্টিতে আমার সহপাঠীর কি দেখছিলেন ? তখন দেখলাম চোখদুটো আপনার ছলছল করছিল ?
উত্তরে বামাক্ষ্যাপা বললেন, “বাবা ধর্মের এখন বড়ই গ্লানি। সনাতন হিন্দুধর্মে লোকের বিশ্বাস ও আস্থা কমে গেছে ম্লেচ্ছ সংসর্গে। কিন্তু এই যূবককে দেখে হৃদয়ে আমার আশার সঞ্চার হচ্ছে। মহাতেজস্বী ব্রহ্মচর্যপরায়ণ এই যুবক কালে মুখ উজ্জ্বল করবে হিন্দুধর্মের। তাই একদৃষ্টিতে দেখছিলাম তাকে”।
বামদেব বাবার এই ভবিষ্যতবাণী শুনে আনন্দে আপ্লুত হলেন শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী। শরৎ চক্রবর্তীর পরবর্তী নাম হয় সদানন্দ। বিবেকানন্দই সদানন্দকে দীক্ষা দিয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে বামাক্ষ্যাপা বাবার কথাগুলি সার্থক ও সত্য হয়েছিল। এই ঘটনার বছর দশেক পর আমেরিকার চিকাগো ধর্মমহাসভায় হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান বিশ্বজয়ী করেছিল স্বামীজিকে।
ইহজীবনের শেষ দিকে বামাক্ষ্যাপা কথা প্রায় বলতেনই না। যখন বলতেন‚ হয় মৃত্যু নিয়ে বলতেন কিংবা তারা মায়ের জন্য কেঁদে ভাসাতেন –
“মরিব আর অমনি যাইব ব্রহ্মে মিশায়ে,
তারার চরণে লুটায়ে শিমূলতলে লুকায়ে।
ক্ষেপা মরিবে অমনি যাইবে ব্রহ্মে মিশায়ে,
কাজ কিরে মন ভোগাশ্রয়ে এ দেহ ধরিয়ে।”
তারাপীঠের মহাশ্মশানে ক্ষ্যাপাবাবা কুটিরের দাওয়ায় বসে প্রায়ই এই গানটি ভক্তিভরে গাইতেন। গাইতে গাইতে তাঁর চোখদুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠত, গান শেষ হবার সাথে সাথেই সমাধিস্থ হতেন।
১৩১৮ সালের ২রা শ্রাবণ সাধকশ্রেষ্ঠ শ্রীবামাক্ষ্যাপা অমৃতলোকে গমন করেন।
.
জয় তারা জয় মা তারা
জয় বাম জয় মা তারা
.
(সংগৃহীত)
collected from different sources
published by Shruti Adhya Kundu , marketing officer of SYCN