সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজানো হয় কেন? এবং শঙ্খ তিন বার বাজানোর পিছনে কি কারণ?

Images

Images

 

 

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সংস্কৃতিতে শঙ্খ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় প্রতীক। হিন্দুধর্মে শঙ্খকে পবিত্রতা, সৌভাগ্য ও শক্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়। সন্ধ্যাবেলায় মন্দিরে বা বাড়িতে শঙ্খ বাজানো এক বিশেষ প্রথা, যা শুধু ধর্মীয় আচরণ নয়, বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।

শঙ্খ কী ও এর ধর্মীয় তাৎপর্য:
শঙ্খ মূলত একটি সামুদ্রিক ঝিনুক, যা প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হয়। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, শঙ্খ দেবতা বিষ্ণুর একটি অস্ত্র, যেটিকে তিনি তার ডান হাতে ধারণ করেন। শঙ্খ থেকে উৎপন্ন ধ্বনি অশুভ শক্তিকে দূরে রাখে এবং পরিবেশকে পবিত্র করে তোলে বলে বিশ্বাস করা হয়।

সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজানোর পেছনে কারণসমূহ:

১. ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক কারণ:
সন্ধ্যা হল দিন ও রাতের সংযোগকাল – এই সময় হিন্দু ধর্মে “সন্ধ্যা আরতি” বা উপাসনা করা হয়। এই আরতির শুরুতে বা শেষে শঙ্খ বাজানো হয় ঈশ্বরের আরাধনার অংশ হিসেবে। শঙ্খ ধ্বনিতে পরিবেশ পবিত্র হয় এবং তা মনকে একাগ্র করে ভক্তিময় চেতনা জাগায়।

২. বৈজ্ঞানিক কারণ:
শঙ্খ বাজালে উচ্চ কম্পাঙ্কের একটি শব্দ তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এই শব্দ বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসে সহায়ক। ফলে সন্ধ্যাবেলায় যখন সূর্যের আলো কমতে থাকে এবং জীবাণু সক্রিয় হয়, তখন শঙ্খ ধ্বনি পরিবেশকে জীবাণুমুক্ত করতে সাহায্য করে।

৩. মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব:
শঙ্খের ধ্বনি শ্রবণ করলে মানুষের মন শান্ত হয়। এটি মানসিক চাপ কমায় এবং মনোসংযোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সন্ধ্যাবেলায় দিনের ক্লান্তি কাটিয়ে নতুন প্রেরণা পাওয়ার একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায় শঙ্খ ধ্বনি।

একটি সময়ে গ্রামে-গঞ্জে সন্ধ্যার সময় শঙ্খ বাজানো একটি সামষ্টিক কার্যকলাপ ছিল। এতে করে প্রত্যেকেই সন্ধ্যার উপাসনার জন্য প্রস্তুতি নিত। এটি একটি ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি করত।

শঙ্খ তিন বার বাজানোর পিছনে কারণ:

হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে শঙ্খ সাধারণত তিনবার বাজানো হয়, এবং এর পেছনে রয়েছে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও প্রতীকী ব্যাখ্যা। নিচে এই তিনবার শঙ্খ বাজানোর প্রধান কারণগুলো তুলে ধরা হলো:

১. তিনটি দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা (ত্রিদেব):

শঙ্খ তিনবার বাজানো হয় ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর – এই ত্রিদেবের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার জন্য।

প্রথমবার শঙ্খ বাজানো হয় ব্রহ্মা – সৃষ্টি কর্তার উদ্দেশ্যে।

দ্বিতীয়বার বাজানো হয় বিষ্ণু – পালন কর্তার উদ্দেশ্যে।

তৃতীয়বার বাজানো হয় শিব/মহেশ্বর – সংহার কর্তার উদ্দেশ্যে।

 

২. শরীর, মন ও আত্মার শুদ্ধির জন্য:

শঙ্খ ধ্বনি যখন তিনবার বাজে, তখন তা মানুষের শরীর, মন, ও আত্মা – এই তিনটি স্তরে পবিত্রতা আনে বলে বিশ্বাস করা হয়।

এটি শরীরকে সক্রিয় করে,

মনকে একাগ্র করে,

আত্মাকে জাগ্রত করে।

 

৩. তিনটি কাল বা সময়কে নির্দেশ করে:

শঙ্খের তিনবার ধ্বনি অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যত – এই তিন সময়কে প্রতীকীভাবে বোঝায়।
এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সমস্ত সময়েই ঈশ্বরের উপস্থিতি রয়েছে এবং আমাদের প্রতিটি কর্মে তাঁর স্মরণ থাকা উচিত।

৪. বৈদিক ব্যাখ্যা – ত্রিগুণ (সত্ব, রজ, তম):

হিন্দু দর্শনে বলা হয়, সৃষ্টির মূল তিনটি গুণ আছে – সত্ত্ব (শুদ্ধতা), রজ (ক্রিয়া), এবং তম (জড়তা)।
শঙ্খ ধ্বনি এই তিন গুণের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সত্ত্বগুণকে জাগ্রত করে, যা ধ্যান ও পূজার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে।

৫. আচার শুরুর সংকেত:

শঙ্খ তিনবার বাজানোর মাধ্যমে পূজা বা যেকোনো আচার শুরুর জন্য দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

প্রথম ধ্বনিতে পরিবেশ শুদ্ধ হয়,

দ্বিতীয় ধ্বনিতে ভক্তদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়,

তৃতীয় ধ্বনিতে ঈশ্বরের কাছে আহ্বান জানানো হয়।

সন্ধ্যায় শঙ্খ বাজানো শুধুই একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, এর পেছনে রয়েছে গহীন বৈজ্ঞানিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক দিক। এই প্রাচীন রীতি আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি পরিবেশ, মন ও সমাজকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। তাই এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ।

কেন মালা জপ করা হয়?

Images (1)

Images (1)

মালা জপ করা একটি প্রচলিত আধ্যাত্মিক অনুশীলন, যা ধর্মীয় ও ধ্যানমূলক কার্যকলাপে ব্যবহৃত হয়। এটি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মানুষের মন, শরীর ও আচরণের উপর প্রভাব ফেলে। নিচে মালা জপের আধ্যাত্মিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরা হলো:

আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা

1. চিন্তাভাবনা কেন্দ্রীভূত করা (Focus):
মালা জপ করলে মন একটি নির্দিষ্ট শব্দ বা মন্ত্রের প্রতি কেন্দ্রীভূত থাকে। এতে মন ছুটোছুটি না করে শান্ত থাকে।

2. ভক্তি ও আত্মসমর্পণ প্রকাশ:
মালার মাধ্যমে ঈশ্বরের নাম বা গুণগান করা হয় বারংবার, যা ভক্তির প্রকাশ এবং আত্মসমর্পণের প্রতীক।

3. কার্মিক বন্ধন হ্রাস:
হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয় যে, জপের মাধ্যমে পূর্বজন্মের কুকর্মের প্রতিক্রিয়া হ্রাস পায়।

4. মন ও আত্মার শুদ্ধতা:
নিরবিচারে একমনে জপ করলে অন্তর শুদ্ধ হয়, অহং কমে এবং আত্মার সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে ওঠে।

5. সতত স্মরণ (Constant Remembrance):
‘নামস্মরণ’ একধরনের সাধনা যা মনে ঈশ্বরচিন্তা ধরে রাখে।

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

1. মনের প্রশান্তি (Mental Calmness):
মালা জপ ধ্যানের মতোই মস্তিষ্কে আলফা তরঙ্গ উৎপন্ন করে, যা মানসিক চাপ হ্রাস করে এবং প্রশান্তি এনে দেয়।

2. Heart Rate ও Respiration-এর নিয়ন্ত্রণ:
ধীরে ধীরে মন্ত্র জপ করার সময় শ্বাসপ্রশ্বাস ও হার্টবিট নিয়মিত হয়ে যায়, ফলে স্নায়ুব্যবস্থা শান্ত হয়।

3. Neuroplasticity ও Habit Loop:
নিয়মিত জপ মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে একটি নির্দিষ্ট রুটিনে অভ্যস্ত করে তোলে। এতে অভ্যাসগত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটে।

4. Mantra-এর শব্দতরঙ্গ:
বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে কিছু নির্দিষ্ট মন্ত্র (যেমন “ওঁ”) উচ্চারণ করলে মস্তিষ্কে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির কম্পন হয়, যা শরীরকে নিরাময় প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে।

5. Cognitive Benefits:
নিয়মিত মালা জপ মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি উন্নত করে এবং একাগ্রতা বৃদ্ধি করে। এটি ADHD বা মনোযোগ ঘাটতি সমস্যায়ও উপকারী।

নিচে বিভিন্ন ধর্মে মালার ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। আপনি দেখতে পাবেন, ধর্ম ভিন্ন হলেও মালার মূল উদ্দেশ্য — মনকে একাগ্র করা, ঈশ্বর/আত্মা স্মরণ, এবং আত্ম-উন্নতির পথ প্রশস্ত করা — এক রকম।

১. হিন্দু ধর্ম

মালা: সাধারণত ১০৮টি দানা থাকে (যাকে জপমালা বলা হয়)। তুলসী, রুদ্রাক্ষ, চন্দনের দানা প্রথিত।

ব্যবহার: “ওঁ নমঃ শিবায়”, “হরে কৃষ্ণ”, “গায়ত্রী মন্ত্র” ইত্যাদি জপে ব্যবহৃত।

উদ্দেশ্য: একাগ্রতা, আত্মশুদ্ধি, পুণ্য অর্জন এবং ঈশ্বরের স্মরণ।

 

২. বৌদ্ধ ধর্ম

মালা: সাধারণত ১০৮টি দানা থাকে, মাঝে মাঝে 27 বা 54 দানাও ব্যবহার হয়। কাঠ, হাড় বা রুদ্রাক্ষ থেকে তৈরি।

ব্যবহার: বৌদ্ধ মন্ত্র যেমন “ওঁ মণিপদ্মে হুং” জপের জন্য।

উদ্দেশ্য: কুসংস্কার মুক্তি, করুণা ও প্রজ্ঞা চর্চা, পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি (নির্বাণ)।

 

৩. খ্রিস্টান ধর্ম

মালা: ক্যাথলিক ধর্মে একে Rosary বলা হয়, সাধারণত ৫টি সেটে বিভক্ত থাকে, প্রতিটি সেটে ১০টি দানা (decade)।

ব্যবহার: প্রার্থনা বা Hail Mary, Our Father, Glory Be প্রার্থনা জপের জন্য।

উদ্দেশ্য: যীশুখ্রিস্ট ও ভার্জিন মেরির জীবনের ঘটনাবলি স্মরণ, আত্মশুদ্ধি ও ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়া।

 

৪. ইসলাম ধর্ম

মালা: একে বলা হয় তসবিহ বা সুবহানী মালা, সাধারণত ৩৩, ৯৯ বা ১০০ দানা হয়।

ব্যবহার: আল্লাহর ৯৯টি নাম জপ করা বা “সুবহানাল্লাহ”, “আলহামদুলিল্লাহ”, “আল্লাহু আকবর” বলার জন্য।

উদ্দেশ্য: ধ্যান, আল্লাহর প্রশংসা, আত্মশুদ্ধি ও নফস (অহং) দমন।

 

৫. শিখ ধর্ম

মালা: কম ব্যবহৃত হলেও, কেউ কেউ সিমরণ বা ঈশ্বরস্মরণ করার জন্য মালা ব্যবহার করেন।

ব্যবহার: “ওঁকার”, “সতনাম”, “ওয়াহেগুরু” — এসব শব্দের জপ।

উদ্দেশ্য: ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন, আত্মদর্শন এবং অহং থেকে মুক্তি।

মালা জপ শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয় বরং এটি একটি মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা বৃদ্ধিকারী প্রক্রিয়া। এটির মাধ্যমে ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের ভিতরের দিকে যাত্রা করে এবং আত্ম উপলব্ধির পথে অগ্রসর হয়। যদিও বিভিন্ন ধর্মে মন্ত্র, শব্দ, ও মালার রূপ ভিন্ন, তবুও এর মূল লক্ষ্য এক — মনকে নিয়ন্ত্রণ করা, আত্মিক উন্নতি সাধন, এবং ঈশ্বর বা চূড়ান্ত সত্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।

অতিরিক্ত তথ্য: কেন সংখ্যাটি ১০৮ হয় (হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মে)?

১০৮ একটি পবিত্র সংখ্যা বলে ধরা হয়। বিভিন্ন ব্যাখ্যা আছে:

১ = ঈশ্বর, ০ = শূন্যতা, ৮ = অনন্ত (∞)

সংস্কৃত বর্ণমালায় ৫৪টি ধ্বনি, প্রতিটির স্ত্রী ও পুং রূপ = ৫৪×২ = ১০৮

জ্যোতিষশাস্ত্রে, সূর্য ও চন্দ্রের পৃথিবী থেকে গড় দূরত্ব তাদের ব্যাসের প্রায় ১০৮ গুণ।