হিন্দু ধর্মে প্রতিটি বার (দিন) একেকটি দেবতা বা দেবীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যেমন সোমবার শিবের দিন, মঙ্গলবার হনুমানের, আর বৃহস্পতিবার বা লক্ষ্মীবার হলো লক্ষ্মীদেবীর পুজোর জন্য বিশেষ দিন। এই দিনে বহু হিন্দু গৃহবধূ উপবাস পালন করেন, লক্ষ্মীদেবীর পূজা করেন এবং পরিবারে সুখ, শান্তি ও ধন-সম্পদের প্রার্থনা করেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, ঠিক কেন বৃহস্পতিবারকেই ‘লক্ষ্মীবার’ হিসেবে মানা হয়? চলুন, এর ঐতিহাসিক, শাস্ত্রীয় ও সামাজিক দিক থেকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি।
বৃহস্পতিবার – ‘লক্ষ্মীবার’ এর ধর্মীয় ভিত্তি
বৃহস্পতি গ্রহ ও লক্ষ্মীর সম্পর্ক :
বৃহস্পতিবারকে সংস্কৃত ভাষায় বলে “গুরুবার” বা “বৃহস্পতিবার”, যেটি বৃহস্পতি গ্রহ এবং দেবগুরু বৃহস্পতি-র সঙ্গে সম্পর্কিত। বৃহস্পতি গ্রহকে হিন্দু জ্যোতিষে ধন, ধর্ম, জ্ঞান, ভাগ্য এবং পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। লক্ষ্মীদেবী যেহেতু ধন ও সমৃদ্ধির দেবী, তাই এই দিনের সঙ্গে তাঁর এক প্রাকৃতিক মিল রয়েছে।
বৃহস্পতির আশীর্বাদ থাকলে জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি আসে, আর লক্ষ্মী পূজা সেই সৌভাগ্যকে আহ্বান করে। এই বিশ্বাস থেকেই বৃহস্পতি ও লক্ষ্মীর মধ্যে এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
পুরাণ ও লোকবিশ্বাস অনুযায়ী ব্যাখ্যা
পুরাণ অনুসারে:
একাধিক পুরাণে (যেমন: স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণ) বলা হয়েছে যে লক্ষ্মীদেবী সেই গৃহে বাস করেন যেখানে শুচিতা, ধর্মাচরণ, ও নিয়মিত পূজা-পাঠ করা হয়। বৃহস্পতির দিন যেহেতু ধর্মীয় আচরণের জন্য শুভ, তাই এই দিনটি বিশেষভাবে লক্ষ্মীপূজার জন্য নির্বাচিত হয়েছে।
লোককথা:
একটি বিখ্যাত লোককথা অনুসারে, এক দরিদ্র পরিবারে এক গৃহবধূ প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পূজা ও উপবাস পালন করতেন। ধীরে ধীরে তার পরিবারে ধন-সম্পদের আগমন ঘটে এবং জীবনে পরিবর্তন আসে। প্রতিবেশীরা তা দেখে অনুসরণ করতে শুরু করে। এইভাবে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজার প্রচলন বাড়ে।
উপবাস ও ব্রতের আধ্যাত্মিক দিক
লক্ষ্মীবার ব্রত মূলত নারীরা পালন করেন। এই ব্রতের মাধ্যমে তারা তাঁদের গৃহে লক্ষ্মীর আগমন কামনা করেন। উপবাসের ফলে শরীর ও মন উভয়ই শুদ্ধ হয়। পূজার আগে গৃহপরিচ্ছন্নতা, ফুল, প্রদীপ, হলুদ ও চন্দনের ব্যবহার – এগুলো সবই শুদ্ধতার প্রতীক।
বৃহস্পতির প্রতিকূল প্রভাব দূর করার উপায়
হিন্দু জ্যোতিষে যাদের বৃহস্পতি গ্রহ দুর্বল, তাঁদের জীবনে আর্থিক অনিশ্চয়তা, ধর্মীয় সংকট ও পারিবারিক অশান্তি দেখা দিতে পারে। তাই বৃহস্পতির শুভ প্রভাব অর্জনের জন্য লক্ষ্মীপূজা সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়।
সামাজিক ও পারিবারিক প্রভাব
বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীবার পালন:
গৃহিণীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসন ও ধৈর্য তৈরি করে
পরিবারে একটি ধর্মীয় পরিবেশ গড়ে তোলে
প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে একটি নির্দিষ্ট দিনে আত্মসংযম ও শুচিতা পালনের সুযোগ দেয়
ছোটদের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলে
লক্ষ্মীবার পালনের নিয়ম সংক্ষেপে
সকালে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে উপবাস শুরু
গৃহপরিচ্ছন্নতা ও পূজাস্থানের শোভা বৃদ্ধি
লক্ষ্মীদেবীর প্রতিমা বা ছবি স্থাপন করে পূজা
প্রদীপ জ্বালানো, হলুদ-সাদা ফুল নিবেদন, খির বা পায়েস প্রসাদ
‘লক্ষ্মীবার ব্রতের কথা’ পাঠ
সন্ধ্যায় উপবাস ভঙ্গ করে সাদাভোজ
বৃহস্পতিবারকে ‘লক্ষ্মীবার’ হিসেবে মানার পেছনে রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস, শাস্ত্রীয় ভিত্তি, সামাজিক রীতিনীতি ও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের সম্মিলন। এটি শুধুমাত্র একটি পূজা নয়, বরং গৃহস্থ জীবনের সৌভাগ্য, শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার এক পবিত্র চর্চা। লক্ষ্মীদেবীর কৃপা লাভের এই উপায় যুগ যুগ ধরে বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।