হিন্দুধর্মে ঈশ্বর বা দেবী-মূর্তিকে জলে বিসর্জন দেওয়া হয় কেন?

Images (1) (4)

Images (1) (4)

 

ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু সংস্কৃতিতে দেবী বা ঈশ্বরের মূর্তিকে জলে বিসর্জন একটি বহু প্রাচীন এবং গভীর অর্থবাহী আচার। এটি কেবল একটি ধর্মীয় নিয়ম নয়, বরং এর মধ্যে নিহিত রয়েছে দর্শন, প্রকৃতি-সচেতনতা ও মানবজীবনের গভীর শিক্ষা। এই প্রবন্ধে বিসর্জনের কারণ, তাৎপর্য ও তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হল।

সৃষ্টি ও লয়ের চক্রের প্রতিফলন

হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয় যে এই জগৎ অনিত্য, অর্থাৎ এখানে যা সৃষ্টি হয়েছে তা একদিন ক্ষয় বা লয়ের মধ্যে মিলিয়ে যাবে। দেবীর মূর্তি সাধারণত নদীর মাটি, খড়, কাঠ ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়। পূজা-অর্চনা শেষে সেই মূর্তি জলে বিসর্জনের মাধ্যমে আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে যায়। এটি প্রকৃতির চক্র—সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়কে প্রতিফলিত করে এবং মানুষকে মনে করিয়ে দেয় যে জীবনের সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী।

ঈশ্বর সর্বব্যাপী — মূর্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নন

হিন্দু ভাবধারায় ঈশ্বর কেবল মূর্তির মধ্যে আবদ্ধ নন, বরং সর্বত্র বিরাজমান। পূজার মাধ্যমে মানুষ ঈশ্বরের এক বিশেষ রূপের কাছে প্রার্থনা করে, আর বিসর্জনের মাধ্যমে বোঝায় যে ঈশ্বর আবার আমাদের চারপাশে, প্রকৃতির প্রতিটি অংশে মিশে গেছেন। এটি মানুষের মন থেকে ‘মূর্তিপূজা’ কে ‘ভাবপূজা’-তে রূপান্তরিত করে।

বৈরাগ্য ও অনাসক্তির শিক্ষা

পূজা বা উৎসবের সময় মানুষের মনে গভীর আসক্তি ও আবেগের জন্ম হয়। বিসর্জনের মাধ্যমে সেই আসক্তি থেকে মুক্ত থাকার শিক্ষা দেওয়া হয়। এ শিক্ষা হল জীবনের যেকোনো প্রিয় জিনিস বা মানুষকে সঠিক সময়ে ছেড়ে দিতে জানা এবং তাতেই জীবনের ভারসাম্য রক্ষা হয়।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার দিক

পুরনো নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিমা তৈরি হতো গঙ্গার মাটি, খড়, কাঠ ও প্রাকৃতিক রঙ দিয়ে; যা নদীতে মিলিয়ে আবার প্রকৃতিকে কোনও ক্ষতি করত না। এর মাধ্যমে প্রকৃতির উপাদান আবার প্রকৃতির মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার এক পরিবেশবান্ধব প্রথা গড়ে উঠেছিল। যদিও এখন রাসায়নিক রঙ ও প্লাস্টার অব প্যারিস ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষণের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তবুও প্রাচীন রীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখা।

উৎসবের সমাপ্তি ও নতুন সূচনা

বিসর্জন উৎসবের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি নির্দেশ করে। এটি এক ধরণের মানসিক প্রস্তুতি, যেখানে মানুষ পূজার আনন্দ ও উদ্দীপনা শেষে আবার দৈনন্দিন জীবনে ফেরার প্রেরণা পায়। এই সমাপ্তির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আগামী বছরের নতুন পূজার আশা ও অপেক্ষা।

দেবী বা ঈশ্বরের মূর্তিকে জলে বিসর্জন দেওয়ার মধ্যে কেবল একটিমাত্র আচার নয়, বরং রয়েছে গভীর দার্শনিক শিক্ষা, প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মানব জীবনের এক মহৎ বার্তা। এটি শেখায়—সব সৃষ্টি একদিন লয়ে মিলে যায়, ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক চিরন্তন। তাই বিসর্জন আমাদের মনে করায়—ত্যাগেই আছে শান্তি, আর অনাসক্তির মধ্যেই আছে জীবনের আসল সৌন্দর্য।

দেবী দুর্গার দশটি হাতের কি অর্থ?

Images (18)

 

Images (18)

 

দুর্গা মা হিন্দু ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেবী, যিনি অসুরবিনাশিনী শক্তির প্রতীক। তিনি মহিষাসুরকে বধ করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দশটি হাত কেবল অলংকারস্বরূপ নয়, বরং প্রতিটি হাতের অস্ত্র ও তার প্রতীকী অর্থ মানব সমাজের জন্য গভীর বার্তা বহন করে। এই দশটি হাত দেবী দুর্গার দশটি শক্তিকে প্রকাশ করে, যা একত্রিত হয়ে তাঁকে ‘অশুভের বিনাশিনী’ রূপে চিহ্নিত করে।

 

দশটি হাতের প্রতীকী অর্থ ও বিশ্লেষণ:

১. ত্রিশূল (ত্রিশূল ধরা হাত):
ত্রিশূল তিনটি গুণের প্রতীক—সত্ত্ব, রজ ও তম। দেবী দুর্গা এই তিন গুণের উপর অধিকার স্থাপন করে জীবকে মোক্ষের পথে নিয়ে যান। এটি শক্তি ও শুদ্ধির প্রতীক।

২. চক্র (সুদর্শন চক্র):
চক্র সময় ও ধর্মের চক্রকে নির্দেশ করে। এটি জানিয়ে দেয় যে অন্যায় করলে তার ফল অনিবার্য, এবং দেবী সবকিছুর নিয়ন্ত্রক।

৩. গদা (গদা ধরা হাত):
গদা প্রতীক শক্তি, কর্তৃত্ব এবং শৃঙ্খলার। দেবীর গদা বোঝায় যে তিনি অন্যায় ও বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সক্ষম।

৪. ধনুর্বাণ (ধনুক ও তীর):
ধনুক নিয়ন্ত্রণ এবং তীর নির্দেশনা—এই দুইয়ের সমন্বয় নির্দেশ করে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সঠিক লক্ষ্যবোধ। দেবী দুর্গা জীবনযুদ্ধে আমাদের দিক নির্দেশনা দেন।

৫. তলোয়ার (খড়গ):
তলোয়ার জ্ঞান ও বিবেকের প্রতীক। মায়ের হাতে খড়গ বোঝায় অজ্ঞতা ও মায়ার বিনাশ।

৬. শঙ্খ:
শঙ্খ ধ্বনি সর্বত্র শুভ শক্তির বিস্তারের প্রতীক। এটি শান্তি, পবিত্রতা ও ঐশ্বরিক কল্যাণের পরিচায়ক।

৭. কমলফুল:
কমল প্রতীক নির্মলতা, নির্লিপ্তি ও আত্মবিশ্বাসের। এটি দেখায়, কাঁদার মধ্যেও পবিত্রতা ও সৌন্দর্য ফুটে উঠতে পারে।

৮. অভয়মুদ্রা (খালি হাত উপরে ওঠানো):
এই মুদ্রা আশ্বাস ও আশীর্বাদের প্রতীক। এটি বোঝায়, “ভয় পেও না, আমি তোমার সঙ্গে আছি।”

৯. বরমুদ্রা (খালি হাত নিচে নামানো):
এই মুদ্রা করুণা ও দানের প্রতীক। দেবী এই হাত দিয়ে ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন।

১০. সাপ/আগুন বা অন্য অস্ত্র:
অধিকাংশ চিত্রে দশম হাতে থাকে অনন্য অস্ত্র বা শক্তির প্রতীক। এটি বোঝায়, দেবীর শক্তি সীমাহীন এবং সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী রূপান্তরিত হয়।

একটি সামাজিক বিশ্লেষণ:

সমাজে নারীকে বহুদিন ধরে অবহেলা করা হয়েছে। কিন্তু দুর্গা মায়ের দশটি হাত সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয়:

নারী শুধু স্নেহময়ী মা নয়,

তিনি যোদ্ধাও হতে পারেন,

নেতা, বিচারক, রক্ষাকর্ত্রী—সবই নারী হতে পারে।

প্রতিটি হাত একটি বার্তা দেয়:

নারী আত্মনির্ভর হতে পারে (অস্ত্রধারণ)।

নারীর ভেতরে নেতৃত্বের শক্তি আছে (চক্র, গদা)।

নারী শুধু সেবা নয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রতীকও (ত্রিশূল, খড়গ)।

সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নারী অপরিহার্য (কমল, শঙ্খ)।

 

সামাজিকভাবে, এটি নারী ক্ষমতায়নের এক উচ্চ প্রতিমূর্তি।

দশটি হাত আসলে দশটি দিক বা গুণের প্রতীক, যা একটি পরিপূর্ণ রক্ষাকর্ত্রী মায়ের রূপ দেয়। এভাবে দেবী দুর্গা বোঝান, একজন সুশক্তিমান নারীও সকল বাধা পেরিয়ে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। তার দশটি হাত প্রতিটি মানুষকে বার্তা দেয়—সাহস, জ্ঞান, নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমাশীলতা ও শক্তির সঠিক ব্যবহারের গুরুত্ব।

দুর্গা মায়ের দশটি হাত শুধুই একটি পৌরাণিক চিত্র নয়, এটি মানব জীবনের একটি পরিপূর্ণ পথপ্রদর্শক চিহ্ন। প্রতিটি হাত আমাদের শেখায় কীভাবে জ্ঞান, সাহস, ন্যায় ও ভক্তি নিয়ে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। দেবী দুর্গার দশভুজা রূপ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নারী মানেই এক অসীম শক্তির আধার।