দুর্গাপূজো হোক বা অন্য যেকোনো পূজা – দেবীর চরণে অঞ্জলি দেওয়া আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। অনেকেই ভাবেন, অঞ্জলি মানে হাতে ফুল নিয়ে প্রণাম করা বা মন্ত্রপাঠের অংশ। কিন্তু অঞ্জলি আসলে শুধুমাত্র একমুঠো ফুল নয়; এটি আমাদের মনের ভক্তি, বিনয় আর সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণের প্রকাশ। এই রীতি যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আত্মিক ও দার্শনিক তাৎপর্য।
🌸 অঞ্জলি শব্দের অর্থ
‘অঞ্জলি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “অঞ্জ্” ধাতু থেকে, যার অর্থ হল “লেপন” বা “আবরণ”। পরে এর অর্থ দাঁড়ায় – দু’হাত জোড় করে তৈরি হওয়া এক ধরনের পাত্র বা “হস্তপুট”, যেখানে আমরা কিছু অ捧ি করে নিবেদন করি। তাই অঞ্জলি আসলে শুধু হাতের মুঠোয় রাখা ফুল নয়, সেই হাতের আকারে তৈরি পবিত্র পাত্রে নিজের মন, প্রাণ ও চেতনা নিবেদন করা।
🪷 শুধু ফুল নয়, আত্মসমর্পণ
অঞ্জলি দেবতাকে দেওয়া হয়, কিন্তু দেবতার জন্য দেবতাকে কিছু দেওয়ার আসলে প্রয়োজন নেই। আসল অর্থ হল – আমরা নিজের অহংকার, লোভ, ক্রোধ, হিংসা, দ্বন্দ্ব এইসব ত্যাগ করে ঈশ্বরের চরণে আত্মসমর্পণ করছি। ফুল এখানে প্রতীক মাত্র; আসল উপহার হল অন্তরের পবিত্রতা আর মনোসংযম।
ত্রিবার অঞ্জলি: এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা
দুর্গাপূজোর অঞ্জলি তিনবার উচ্চারিত মন্ত্রে দেওয়া হয়। এই তিনবার অঞ্জলি দেবীর কাছে শরীর, মন ও বাক্যের দ্বারা সমস্ত পাপক্ষয় ও শুদ্ধতার প্রার্থনা – যাতে আমরা শুধু বাহ্যিক নয়, অন্তরেরও শুদ্ধি অর্জন করতে পারি।
– প্রথম অঞ্জলি: শরীরের অপবিত্রতা ত্যাগের সংকল্প
– দ্বিতীয় অঞ্জলি: মনের অশুদ্ধতা দূর করার প্রার্থনা
– তৃতীয় অঞ্জলি: বাক্যের দোষ ও কুকথা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা
সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক
অঞ্জলি সাধারণত একসাথে অনেক মানুষ মিলে দেওয়া হয়। এতে তৈরি হয় এক ধরনের সমষ্টিগত ভক্তি আর মানসিক সংযোগ। সেই সময় মানুষ একে অপরকে পাশে পায়, সমাজে একাত্মতার অনুভূতি জন্মায়। অঞ্জলি দিতে গিয়ে মাথা নত করা মানে নিজের ইগো বা অহংকার ত্যাগ করার শিক্ষা।
অঞ্জলি কেবল ফুল নয়, আত্মসমর্পণের মাধ্যম। দেবীর চরণে অঞ্জলি দিয়ে আমরা যেন বলি: “মা, যা কিছু ত্রুটি আমার মধ্যে আছে, তা তোমার হাতে সঁপে দিলাম। আমাকে সত্যিকারের ভালো মানুষ হতে শেখাও।” এই অঞ্জলিই আমাদের শিখিয়ে দেয় – ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে বড় উপহার আমাদের পবিত্র মন ও নিঃস্বার্থ আত্মা।