আমরা কেন তিলক ধারণ করি?

 

Images

 

তিলক ধারণ করার প্রথা মূলত হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু একটি আচার নয়, এর পেছনে রয়েছে ধার্মিক ও বৈজ্ঞানিক উভয় ব্যাখ্যা। নিচে তা দুইভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:

ধার্মিক ব্যাখ্যা:

1. ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ:
তিলক ধারণ করা হয় ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রকাশের প্রতীক হিসেবে। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা দেবতার ভক্তরা বিভিন্ন ধরনের তিলক পরিধান করেন, যেমন বিষ্ণুভক্তরা “উ” বা “ত্রিপুণ্ড্র” আকৃতির তিলক নেন।

2. আত্মপরিচয় প্রকাশ:
তিলক কার কোন সম্প্রদায় বা পথের অনুসারী তা প্রকাশ করে। যেমন বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত—প্রত্যেকের তিলকের ধরন আলাদা।

3. আধ্যাত্মিক উন্নতি ও পবিত্রতা:
তিলক ধারণ করা হয় মস্তিষ্কের ‘আজ্ঞাচক্র’ বা ‘তৃতীয় নয়ন’ এর স্থানে, যা ধ্যান, আত্মচিন্তা এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রতীক।

4. ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও পূজার পূর্ব প্রস্তুতি:
পূজা বা যেকোনো ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়ার পূর্বে তিলক ধারণ করে আত্মশুদ্ধি ও মনঃসংযমের প্রকাশ ঘটে।

 

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:

1. মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ চাপ পয়েন্টে চাপ প্রয়োগ:
তিলক সাধারণত কপালের মাঝে, দুই ভ্রুর ঠিক উপরের জায়গায় লাগানো হয়—এই স্থানটি ‘আজ্ঞাচক্র’ বা pineal gland-এর কাছাকাছি, যা মনঃসংযোগ, স্মৃতিশক্তি এবং আত্মউপলব্ধির সাথে জড়িত।

2. মানসিক প্রশান্তি ও ঠান্ডা ভাব বজায় রাখা:
চন্দনের তিলক ঠান্ডা প্রকৃতির, এটি কপালে লাগালে স্নায়ুতন্ত্র শান্ত হয় এবং মানসিক চাপ কমে।

3. রক্তসঞ্চালনের ভারসাম্য:
তিলক লাগানোর সময় যে সামান্য চাপ প্রয়োগ হয় তা রক্তসঞ্চালন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।

4. ইন্দ্রিয় ও চিন্তাশক্তির কেন্দ্র সক্রিয় করা:
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, কপালের এই অংশে নিয়মিত সংবেদন সৃষ্টি করলে চিন্তাশক্তি ও মনোযোগ বৃদ্ধি পায়।

হিন্দু ধর্মে প্রধানত তিনটি মূল সম্প্রদায় দেখা যায়—বৈষ্ণব, শৈব, ও শাক্ত। এদের প্রত্যেকের তিলক আলাদা, এবং প্রতিটির একটি নির্দিষ্ট আধ্যাত্মিক ও দর্শনীয় তাৎপর্য আছে।

বৈষ্ণব তিলক (ভগবান বিষ্ণুর ভক্তরা)

তিলকের রূপ:
দুইটি সাদা উলটো ‘U’ আকারের রেখা, মাঝে সাধারণত একটি লাল বা হলুদ রেখা থাকে।

ব্যবহৃত পদার্থ:
গোপীচন্দন, কুমকুম, হলুদ

অর্থ ও তাৎপর্য:

‘U’ আকৃতির তিলক বিষ্ণুর পদচিহ্নের প্রতীক।

মাঝে লাল রেখাটি লক্ষ্মীর প্রতীক।

এটি ভক্তকে সর্বদা ঈশ্বরস্মরণে রাখে এবং অহংকার কমাতে সহায়ক।

বিশেষ বৈষ্ণব উপপ্রধান ধারা:

মাধ্ব, নিম্বার্ক, গৌড়ীয়, ও রামানুজ সম্প্রদায়ের তিলকের ছোট ভিন্নতা থাকে।

 

শৈব তিলক (ভগবান শিবের ভক্তরা)

তিলকের রূপ:
কপালের ওপর তিনটি অনুভূমিক সাদা রেখা (ত্রিপুণ্ড্র), মাঝে লাল বিন্দু বা রেখা থাকতে পারে।

ব্যবহৃত পদার্থ:
ভস্ম (ভস্মধারিণী), কুমকুম

অর্থ ও তাৎপর্য:

তিনটি রেখা প্রতীক: তামস, রজস ও সত্ত্ব গুণ, বা জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্ম।

এটি আত্মশুদ্ধি ও মোক্ষলাভের প্রতীক।

ভস্ম মানে ‘সব কিছু ধ্বংসযোগ্য’—এটি মোহভঙ্গ ও বৈরাগ্যের প্রতীক।

 

শাক্ত তিলক (দেবী দুর্গা বা শক্তির ভক্তরা)

তিলকের রূপ:
সাধারণত কপালের মাঝখানে একটি লাল বিন্দু (বিন্দি বা কুমকুম)।

ব্যবহৃত পদার্থ:
কুমকুম (সিঁদুর)

অর্থ ও তাৎপর্য:

এটি অগ্নিচক্র বা শক্তিচক্রের প্রতীক।

নারীর শক্তি, মাতৃত্ব, ও পবিত্রতার প্রতীক।

বিবাহিত নারীরা এটি সধবা বা শুভ লক্ষণ হিসেবে ধারণ করেন।

 

৪. স্মার্ত সম্প্রদায় (যাঁরা শিব, বিষ্ণু, দেবী, গণেশ, সূর্য সবাইকে পূজা করেন)

তিলকের রূপ:
কখনও ত্রিপুণ্ড্র, কখনও উর্ধ্ব রেখা বা বিন্দু—ব্যক্তি বা সময় অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।

অর্থ ও তাৎপর্য:
এই সম্প্রদায় সর্বদেবতার প্রতি সমান শ্রদ্ধা রাখে, তাই তিলকের রীতিতেও বৈচিত্র্য দেখা যায়।

 

সারাংশ:
তিলক শুধু একটি ধর্মীয় প্রতীক নয়, এটি আত্মিক উন্নতি, ভক্তি প্রকাশ, ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায়ও কার্যকরী ভূমিকা রাখে—এটি ধার্মিক বিশ্বাস এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মিলিত ব্যাখ্যায় স্পষ্ট হয়।