🔻গোত্র শব্দের অর্থ কুল বা বংশ।সনাতন ধর্মে গোত্র মানে একই পিতার ঔরসজাত সন্তান-সন্ততি দ্বারা সৃষ্ট বংশ পরম্পরা।গো-শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গম্-ধাতু থেকে যার অর্থ- গতি। আর ‘ত্র’ উতপত্তি হয়েছে ত্রৈ-ধাতু থেকে, মানে হলো ত্রাণ করা। তাই গোত্র মানে দাঁড়ায় বংশের ধারা বা গতি যাঁর মাধ্যমে রক্ষিত হয় সেই স্মরনীয় পিতৃপুরুষ। তিনিই গোত্র পিতা।সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্য হলো,এ ধর্মের বংশ রক্ষার ধারায় ঋষিগণ সম্পৃক্ত ছিলেন।এই একেকজন ঋষির বংশ পরম্পরা তাদের নামে এক একটি গোত্র হিসেবে পরিচিত লাভ করে।
পূজা, যজ্ঞ কিংবা বিবাহ যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই গোত্রের নাম জিজ্ঞেস করা হলে নামটা অবলীলায় মুখ থেকে নির্গত হলেও তা কেবল নামসর্বস্বই। এর বাইরে গোত্র সম্বন্ধে খুব কম লোকরই জানা। পারিবারিক পরম্পরায় শুধু নামটিই প্রবাহিত হয়ে আসছে, কিন্তু এর উৎস সম্বন্ধে অধিকাংশই অজ্ঞ।
কীভাবে আমাদের নামের সাথে এই গোত্রটি যুক্ত হয়ে গেল? এর নেপথ্যে কী?
গোত্র সম্পর্কে জানতে হলে এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এর ইতিহাস জানতে হবে। ভগবানের নির্দেশে ব্রহ্মা সৃষ্টি কার্য শুরু করলেন। ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টি বিস্তারের লক্ষ্যে ।তাদের সৃষ্টি করা হলেও ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে মোক্ষ লাভ করে।মোক্ষনিষ্ঠ কুমারেরা সৃষ্টি বিস্তারে কাজ করার অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন।
ব্রহ্মা যখন দেখলেন যে, মহাবীর্যবান ঋষিদের উপস্থিতি সত্ত্বেও সৃষ্টির বিস্তার তথা মনুষ্যকুল পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তখন তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি চিন্তা করলেন, নিজের দেহ থেকে এভাবে সৃষ্টি না করে, নারী-পুরুষের মাধ্যমে সংসার সৃষ্টি হোক। তখন তাঁরা দেহ থেকে প্রান পেয়েছিল আদি মানব পিতা মাতার, তাঁরা হলেন মনু ও শতরূপা।
মনু তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা আকুতিকে রুচি নামক ঋষিকে দান করেন এবং কনিষ্ঠা কন্যা প্রসূতিকে দক্ষের নিকট দান করেন। তাঁদের দ্বারাই সমগ্র জগৎ জনসংখ্যায় পূর্ণ হয়েছে। ব্রহ্মা থেকে সৃষ্ট ঋষিদের থেকেই বিভিন্ন গোত্রের প্রবর্তন হয়েছে।
গোত্র প্রসঙ্গে ভারতীয় গণিতবিদ বৌধায়ন (খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ শতক) এর মত নিম্নরূপ-
বিশ্বামিত্রো জমদগ্নিভরদ্বাজোত্থ গৌতমঃ।
অত্রিবশিষ্ঠঃ কশ্যপ ইত্যেতে সপ্তঋষয়।
সপ্তানাং ঋষিনামগস্ত্যাষ্টমানাং যদপত্যং তদগোত্রম্।।
অর্থাৎ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ,ও কশ্যপ এই সাতজন মুনির পুত্র ও পৌত্র প্রভৃতি অপত্যগণের মধ্যে যিনি ঋষি হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে, তাঁর নামেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গোত্র ।
বৌধায়নসূত্রে বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ ও কশ্যপ এই সাতজন ঋষিই আদি গোত্রকার বলে নির্দিষ্ট আছেন। সাতজন ঋষি থেকে প্রবাহিত গোত্র ব্যতিত আরও কিছু গোত্রের নামও শোনা যায়। তবে এর কারণ হচ্ছে একই গোত্রদ্ভুত কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম অনুসারে পরবর্তী কোনো সময়ে ঐ প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নামে গোত্র পরিচয় দেওয়া। যেমন কাশ্যপ গোত্রের বংশক্রমে যদি কোনো ব্যক্তি প্রসিদ্ধ হয় এবং পরবর্তীতে যদি সেই প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নামে গোত্র পরিচয় হয়ে থাকে । এইরূপ আরও কিছু গোত্র আছে যেমন শাণ্ডিল্য,অগ্যস্ত,কাত্যায়ন, বাৎস্য, সার্বন, কৌশিক, মৌদগল্য, আলম্যান, পরাশর, অত্রি, রোহিত, বৃহস্পতি, গর্গ ইত্যাদি।
প্রায়ই শোনা যায়, একই গোত্রে কেন বিবাহ করা যায়্না?জেনে নেয়া যাক এক্ষেত্রে শাস্ত্রে কী বলা হয়েছে?
একটি বংশের রক্ত ধারাবাহিকভাবে প্রভাবিত হয় পুরুষ পরম্পরায়। বৈদিক যুগ থেকেই একই গোত্রে বিবাহের নিষেধ আছে।কেননা সমগোত্র মানে বর ও কনের কোনো না কোনো পিতৃপুরুষ একই পিতার থেকে এসেছে। রক্তধারা যেহেতু পুরুষ পরম্পরায় প্রবাহিত হয় সুতরাং বংশের রক্তের ধারক বাহক হচ্ছে পুরুষ।এজন্য একই বংশের ছেলে মেয়ের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হতো না।কারণ হিসেবে বৈদিক শাস্ত্রসমূহ বিশেষ করে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, একই রক্তের সম্পর্কের কারো সাথে বিবাহ হলে সন্তান বিকলাঙ্গ, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, মেধা ও বুদ্ধিহীন হয়। শিশু নানা রোগে জরাজীর্ণ হয়ে থাকে। তবে একান্তই প্রয়োজন হলে যেমন পাত্র-পাত্রী না পাওয়া গেলে ১৪ পুরুষ পেরিয়ে গেলে তখন বিবাহ করা যেতে পারে। তবে তা যথাসম্ভব এড়িয়ে চললেই ভালো।
মনুসংহিতায় (মনুসংহিতা ৩/৫-৬) এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–
অসপিন্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।
অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ সপ্তপুরুষ পর্যন্ত মাতামহাদি বংশজাত না হয় ও মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয় এবং পিতার সগোত্রা বা সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয় এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের বিবাহের যোগ্য বলে জানবে।
বৈদিক শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করছেন-
তারা বলছেন, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের পরিণামে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ”দ্য ল্যানসেট” সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন।
((সংগৃহীত))
PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.