বিজয়ায় সিঁদুর কেন খেলা হয়?

Images

Images

বাংলা হিন্দু সংস্কৃতিতে দুর্গাপূজা শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আবেগ, ঐতিহ্য ও আনন্দের এক বিশাল উৎসব। এই পূজার শেষ দিনে, অর্থাৎ বিজয়া দশমীতে, সম্পন্ন হয় একটি বিশেষ রীতি — সিঁদুর খেলা। এই রীতি মূলত বিবাহিত হিন্দু নারীদের মধ্যে পালন করা হয়, যা একদিকে যেমন ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীরভাবে জড়িত, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবেও পরিগণিত।

 

সিঁদুর খেলার মূল অর্থ ও তাৎপর্য:

সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অলংকার। মঙ্গলসূত্র বা শাঁখা-পলার মতো, সিঁদুরও বিবাহিত জীবনের এক শক্তিশালী প্রতীক। তাই সিঁদুর খেলা শুধুমাত্র একটি রঙিন উৎসব নয়, বরং এটি মেয়েদের পারস্পরিক শুভকামনার এক সুন্দর বহিঃপ্রকাশ। দুর্গাপূজা নিজেই নারীশক্তির জাগরণ। আর বিজয়ার দিনে, মা দুর্গা বিদায় নিলেও নারীরা একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে মূলত সেই ‘নারীশক্তি’-কেই নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। যেন শক্তি মা চলে গেলেও, তার কিছুটা আমরা নিজেদের মধ্যেই ধারণ করে রাখি।

বিজয়া দশমীর প্রেক্ষাপটে সিঁদুর খেলা:

বিজয়া দশমী হলো সেই দিন, যেদিন মা দুর্গা তার কৈলাসে ফিরে যান — এই বিদায়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আবেগ, ভালোবাসা এবং এক বিষাদের সুর। এই সময় নারীরা মাকে সিঁদুর দিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে ও প্রণাম করে বিদায় জানান। এরপর তারা একে অপরকে সিঁদুর পরিয়ে দেন এবং মঙ্গল কামনা করেন।

 

সিঁদুর খেলার উদ্দেশ্য ও বিশ্বাস:

১. স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্যের কামনা:
বিবাহিত নারীরা বিশ্বাস করেন, এই দিনে সিঁদুর পরিধান ও বিনিময়ের মাধ্যমে তারা স্বামীর দীর্ঘ জীবন ও পরিবারের কল্যাণ কামনা করেন।

2. দাম্পত্য জীবনের স্থায়িত্বের প্রতীক:
সিঁদুর একদিকে যেমন নারীকে ‘সাধ্বী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তেমনি এটি দাম্পত্য জীবনের শক্ত বন্ধনেরও প্রতীক।

3. নারীদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য:
একে অপরকে সিঁদুর লাগিয়ে নারীরা সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করেন, যা নারীর প্রতি নারীর সম্মান ও ভালোবাসার প্রকাশ।

4. উৎসবের আনন্দ:
সিঁদুর খেলার মাধ্যমে পূজার শেষ দিনে এক বিষাদের মধ্যেও আনন্দের রঙ ছড়িয়ে পড়ে। এই রঙিন পরিপূর্ণতা সবার মনকে আনন্দিত করে তোলে।

 

সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মূল্যায়ন:

আজকের দিনে, সিঁদুর খেলা শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিধিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক মিলনক্ষেত্র। বহু পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, এমনকি অজানা মানুষও এই উৎসবে একত্রিত হন। ছবি তোলা, হেসে-খেলে রঙে মাখামাখি হওয়া — সব মিলিয়ে এটি এক হৃদ্যতাপূর্ণ মিলনমেলা।

 

সিঁদুর খেলা কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়; এটি নারীর প্রতি নারীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও একতা প্রকাশের এক অসাধারণ প্রতীক। এটি বিজয়া দশমীর বিষাদের আবহেও এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি করে। যুগ বদলেছে, সময়ের সাথে অনেক কিছু পাল্টেছে, কিন্তু সিঁদুর খেলার ঐতিহ্য আজও তার আবেদন হারায়নি। বরং এটি নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা সংস্কৃতির এক গর্বিত পরিচয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। আর এখন শুধু দুর্গাপূজা নয় বিশেষ করে সব পুজোতেই সিঁদুর খেলার রীতি প্রচলিত হয়েছে।

অঞ্জলি দেওয়া – শুধু ফুল নয়, আত্মসমর্পণের প্রতীক।

Images (1) (1)

Images (1) (1)

 

দুর্গাপূজো হোক বা অন্য যেকোনো পূজা – দেবীর চরণে অঞ্জলি দেওয়া আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। অনেকেই ভাবেন, অঞ্জলি মানে হাতে ফুল নিয়ে প্রণাম করা বা মন্ত্রপাঠের অংশ। কিন্তু অঞ্জলি আসলে শুধুমাত্র একমুঠো ফুল নয়; এটি আমাদের মনের ভক্তি, বিনয় আর সর্বোচ্চ আত্মসমর্পণের প্রকাশ। এই রীতি যেমন দেখতে সুন্দর, তেমনি এর গভীরে লুকিয়ে আছে আত্মিক ও দার্শনিক তাৎপর্য।

 

🌸 অঞ্জলি শব্দের অর্থ

‘অঞ্জলি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “অঞ্জ্” ধাতু থেকে, যার অর্থ হল “লেপন” বা “আবরণ”। পরে এর অর্থ দাঁড়ায় – দু’হাত জোড় করে তৈরি হওয়া এক ধরনের পাত্র বা “হস্তপুট”, যেখানে আমরা কিছু অ捧ি করে নিবেদন করি। তাই অঞ্জলি আসলে শুধু হাতের মুঠোয় রাখা ফুল নয়, সেই হাতের আকারে তৈরি পবিত্র পাত্রে নিজের মন, প্রাণ ও চেতনা নিবেদন করা।

 

🪷 শুধু ফুল নয়, আত্মসমর্পণ

অঞ্জলি দেবতাকে দেওয়া হয়, কিন্তু দেবতার জন্য দেবতাকে কিছু দেওয়ার আসলে প্রয়োজন নেই। আসল অর্থ হল – আমরা নিজের অহংকার, লোভ, ক্রোধ, হিংসা, দ্বন্দ্ব এইসব ত্যাগ করে ঈশ্বরের চরণে আত্মসমর্পণ করছি। ফুল এখানে প্রতীক মাত্র; আসল উপহার হল অন্তরের পবিত্রতা আর মনোসংযম।

ত্রিবার অঞ্জলি: এর আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা

দুর্গাপূজোর অঞ্জলি তিনবার উচ্চারিত মন্ত্রে দেওয়া হয়। এই তিনবার অঞ্জলি দেবীর কাছে শরীর, মন ও বাক্যের দ্বারা সমস্ত পাপক্ষয় ও শুদ্ধতার প্রার্থনা – যাতে আমরা শুধু বাহ্যিক নয়, অন্তরেরও শুদ্ধি অর্জন করতে পারি।

– প্রথম অঞ্জলি: শরীরের অপবিত্রতা ত্যাগের সংকল্প
– দ্বিতীয় অঞ্জলি: মনের অশুদ্ধতা দূর করার প্রার্থনা
– তৃতীয় অঞ্জলি: বাক্যের দোষ ও কুকথা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা

সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক

অঞ্জলি সাধারণত একসাথে অনেক মানুষ মিলে দেওয়া হয়। এতে তৈরি হয় এক ধরনের সমষ্টিগত ভক্তি আর মানসিক সংযোগ। সেই সময় মানুষ একে অপরকে পাশে পায়, সমাজে একাত্মতার অনুভূতি জন্মায়। অঞ্জলি দিতে গিয়ে মাথা নত করা মানে নিজের ইগো বা অহংকার ত্যাগ করার শিক্ষা।

 

অঞ্জলি কেবল ফুল নয়, আত্মসমর্পণের মাধ্যম। দেবীর চরণে অঞ্জলি দিয়ে আমরা যেন বলি: “মা, যা কিছু ত্রুটি আমার মধ্যে আছে, তা তোমার হাতে সঁপে দিলাম। আমাকে সত্যিকারের ভালো মানুষ হতে শেখাও।” এই অঞ্জলিই আমাদের শিখিয়ে দেয় – ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে বড় উপহার আমাদের পবিত্র মন ও নিঃস্বার্থ আত্মা।

অন্য ধর্মের তুলনায় হিন্দুধর্মে এত দেব-দেবী কেন? : একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা

Images (28)

Images (28)

 

বিশ্বে নানা ধর্মের অনুসারীরা আছেন, প্রত্যেক ধর্মের নিজস্ব বিশ্বাস ও অনুশাসন রয়েছে। তবে হিন্দুধর্মের একটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো—এতে দেব-দেবীর সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। বিষ্ণু, শিব, ব্রহ্মা থেকে শুরু করে লক্ষ্মী, দুর্গা, সরস্বতী এবং আরো অগণিত দেব-দেবী হিন্দু ধর্মে বিদ্যমান। অন্য ধর্মের তুলনায় এত দেব-দেবী কেন—এই প্রশ্ন বহুদিন ধরেই মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর উত্তর পেতে হলে আমাদের হিন্দু ধর্মের ইতিহাস, দর্শন, সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় মনোভাব বিশ্লেষণ করতে হবে।

হিন্দুধর্মের বহুত্ববাদী স্বভাব:

হিন্দুধর্ম একক কোনো ধর্মগ্রন্থ বা একজন প্রবর্তক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। এটি একটি চিরায়ত জীবনব্যবস্থা, যা হাজার হাজার বছর ধরে বিকশিত হয়েছে। এই ধর্মে একাধারে রয়েছে ঐক্য (Advaita) এবং বহুত্ব (Dvaita)—এই দ্বৈত ধারণার সহাবস্থান। এই জন্যই একদিকে ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এক, কিন্তু সেই ব্রহ্ম নানা রূপে অবতীর্ণ হতে পারে—এই বিশ্বাস থেকেই বহু দেব-দেবীর ধারণার উদ্ভব।

দর্শনগত ব্যাখ্যা:

হিন্দু দর্শনে বিশ্বাস করা হয়, “একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি”, অর্থাৎ “সত্য এক, জ্ঞানীরা তাঁকে বিভিন্ন নামে ডাকেন।” তাই হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের একাধিক রূপ সৃষ্টি হয়েছে, যেমন:

ত্রিমূর্তি ধারণা: ব্রহ্মা (সৃষ্টি), বিষ্ণু (পালন), ও শিব (বিনাশ)

শক্তি আরাধনা: নারীরূপী দেবীর পূজা, যেমন দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী ইত্যাদি

অবতারবাদ: ঈশ্বর ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন রূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন—যেমন রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ইত্যাদি।

এই দর্শন অনুযায়ী, মানুষের মনোবৃত্তি ও চাহিদা অনুযায়ী ঈশ্বরের রূপ পরিবর্তিত হয়।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ:

ভারত একটি বিশাল ও বৈচিত্র্যময় দেশ। বিভিন্ন অঞ্চল, জাতি, উপজাতি ও সংস্কৃতির মধ্যে সহাবস্থানের ফলে প্রতিটি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব উপাস্য দেবতা তৈরি করেছে। যেমন:

কৃষিজীবী সমাজে ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নির পূজা ছিল

শিক্ষা ও জ্ঞানের জন্য সরস্বতী

ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য লক্ষ্মী

রোগ নিরাময়ের জন্য ধন্বন্তরি ইত্যাদি

এইভাবে সমাজের নানা প্রয়োজন মেটাতে বিভিন্ন দেবতার পূজা জনপ্রিয় হয়েছে।

আস্তিকতা বনাম নাস্তিকতা:

হিন্দুধর্ম একটি উদার ধর্ম। এখানে এমনকি ঈশ্বরে অবিশ্বাস করাও গ্রহণযোগ্য। চার্বাক দর্শন, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু মতবাদের আশ্রয়ে থেকেই গড়ে উঠেছে। এই উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলে বহুবিধ চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছে এবং প্রতিটি চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটেছে বিভিন্ন দেবতা বা উপাসনার মাধ্যমে।

মানবিক মনোভাব ও প্রতীকী ব্যাখ্যা:

হিন্দু দেব-দেবীগণ শুধু ঐশ্বরিক শক্তির প্রতীক নন, বরং মানুষের গুণাবলির প্রতিচ্ছবি। যেমন:

সরস্বতী প্রতীক জ্ঞান ও সংগীতের

দুর্গা প্রতীক শক্তি ও সাহসের

বৃদ্ধ হনুমান প্রতীক ভক্তি ও সেবার

এভাবে প্রতিটি দেবতার মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়।

অতএব, হিন্দু ধর্মে এত দেব-দেবীর উপস্থিতি শুধু ধর্মীয় নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, ও দার্শনিক প্রক্রিয়ার ফল। এটি বহুত্ববাদ, সহনশীলতা এবং উদার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন। যদিও অন্য ধর্মগুলোতে একেশ্বরবাদ প্রধান, হিন্দুধর্ম বহু দেবতার মাধ্যমে ঐক্যের পথ দেখায়—সবই এক পরমাত্মার বিভিন্ন রূপ। এই কারণেই হিন্দু ধর্ম এত দেব-দেবীতে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।