গণেশ চতুর্থীর সময়েই নয়, বরং প্রতিটি পূজা বা উপাসনার আগে গণেশের পূজা করা হয়। কিন্তু আপনি কি জানেন যে মুদ্গলা পুরাণ অনুসারে, গণেশ আটটি অবতার গ্রহণ করেছিলেন দুষ্ট শক্তিদের পরাজিত করার জন্য, যারা মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দোষ বা দুর্বলতার প্রতীক ছিল? এই দোষ দেবতাদের মধ্যেও বিদ্যমান ছিল, এবং সেখান থেকেই ওই অসুরদের জন্ম হয়। গণেশের প্রতিটি অবতারে তাঁর মাথা ও শুঁড় ছিল হাতির মতো, তবে তিনি কিছু অবতারে তাঁর বাহন মূষিকের পরিবর্তে অন্য প্রাণীদের গ্রহণ করেছিলেন। চলুন, গণেশের প্রতিটি অবতারের গল্প জেনে নেওয়া যাক।
বক্রতুন্ড
গণেশের প্রথম অবতার হলেন বক্রতুন্ড, যার অর্থ বাঁকানো শুঁড়। একবার, ইন্দ্রের প্রমাদ (অসতর্কতা) থেকে জন্ম নেয় মৎসরাসুর নামের এক অসুর। মৎসর অর্থ হিংসা ও স্বার্থপরতা। কঠোর তপস্যার পর, শিবের কাছ থেকে সে অজেয় হওয়ার বর পায়। এরপর তার দুই পুত্র সুন্দরপ্রিয় ও বিষয়প্রিয়কে সঙ্গে নিয়ে সে তিনটি লোক জয় করে এবং সর্বত্র আতঙ্ক সৃষ্টি করে। অসহায় দেবতারা শেষ পর্যন্ত দত্তাত্রেয়ের শরণ নেন। তিনি দেবতাদের ‘গম’ (Gam) মন্ত্র জপ করতে বলেন, যা করলে বক্রতুন্ড আবির্ভূত হন। তিনি সিংহের ওপর আরোহণ করে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং মৎসরাসুরের দুই পুত্রকে বধ করেন। তার অসীম শক্তি দেখে মৎসরাসুর আত্মসমর্পণ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। বক্রতুন্ড তাকে ক্ষমা করে বিশ্বে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
একদন্ত
চ্যবন ঋষির পুত্র মদাসুর মদ্যপানে আসক্ত ছিল। তার কাকা শুক্রাচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে সে বিশ্ব জয় করতে চায়। শুক্রাচার্য তাকে হ্রীং মন্ত্র প্রদান করেন, যার শক্তিতে সে অসীম ক্ষমতা লাভ করে এবং তিনটি লোক জয় করে। দেবতারা সন্ত কুমারের শরণ নিলে তিনি একদন্ত অবতারের আরাধনা করতে বলেন। মূষিক বাহনে আরোহণ করে একদন্ত উপস্থিত হন, কিন্তু তাঁর মহিমা দেখে মদাসুর নিজেই ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। একদন্তের এই অবতার আমাদের শেখায় যে, নেশা ও অহংকার মানুষের পতনের কারণ হতে পারে।
মহোদর
গণেশের তৃতীয় অবতার মহোদরের কাহিনীর দুটি সংস্করণ আছে। একটিতে বলা হয়, মোহাসুর সূর্যদেবের উপাসনা করে অপরাজেয় হয়েছিল। অন্যটি বলে, পার্বতী দেবী একবার শিবের ধ্যান ভঙ্গ করতে এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেন, যা পরে পরিত্যক্ত হয়ে মোহাসুর নামে অসুরে রূপান্তরিত হয়। দুই ক্ষেত্রেই, সূর্যদেবের পরামর্শে দেবতারা মহোদরের আরাধনা করলে তিনি মূষিক বাহনে উপস্থিত হন। তাঁর প্রভাবে মোহাসুর আত্মসমর্পণ করে এবং পরম ভক্ত হয়ে ওঠে।
গজানন
কুবের একবার কৈলাসে এসে পার্বতীর প্রতি কুদৃষ্টি দেন। পার্বতীর ক্রোধে কুবের কাঁপতে থাকেন, আর এই ভয় থেকে জন্ম নেয় লোভাসুর। শুক্রাচার্যের শিষ্য হয়ে লোভাসুর কঠোর তপস্যার মাধ্যমে অসীম শক্তি অর্জন করে এবং তিনটি লোক জয় করে। দেবতারা ঋষি রৈভ্যের কাছে গেলে তিনি গজাননকে আহ্বান করতে বলেন। গজাননের উপস্থিতিতেই লোভাসুর অনুশোচনায় ভেঙে পড়ে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই অবতার আমাদের শেখায় যে লোভ আত্মাকে ধ্বংস করে।
লম্বোদর
সমুদ্র মন্থনের সময় বিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করেন, যা দেখে শিব মুগ্ধ হন। পরে শিবের এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই জন্ম নেয় ক্রোধাসুর। শুক্রাচার্যের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করে সে অসাধারণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। লম্বোদর অবতারে গণেশ তাঁর বিশাল উদরের মাধ্যমে ক্রোধাসুরের সমস্ত ক্রোধ ধারণ করেন এবং তাকে শান্ত করেন। এই অবতার দেখায় যে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ না করলে তা সর্বনাশা হতে পারে।
বিকট
কামাসুর জন্ম নেয় বিষ্ণু ও জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দার মধ্য থেকে। শুক্রাচার্যের পরামর্শে সে কঠোর তপস্যা করে এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দেবতারা ঋষি মুদ্গলার পরামর্শে ‘ওম’ ধ্বনি উচ্চারণ করে বিকট অবতারের আহ্বান করলে গণেশ ময়ূর বাহনে আসেন ও কামাসুরকে পরাজিত করেন।
বিঘ্নরাজ
পার্বতীর হাসি থেকে এক সুন্দর বালকের জন্ম হয়, যার নাম রাখা হয় ‘মম’ (আমার)। পরে সে অসুরদের সঙ্গে মিশে মমাসুর নামে পরিচিত হয় ও তিনটি লোক জয় করে। দেবতাদের আহ্বানে গণেশ বিঘ্নরাজ অবতারে শেশনাগ বাহনে আরোহণ করে তাকে পরাজিত করেন। এই অবতার দেখায় যে আসক্তি মোহের জন্ম দেয়, যা আত্মার প্রকৃত মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
ধূম্রবর্ণ
সূর্যদেব একবার অহংকার করে ভাবেন যে কর্মের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে, তাই তিনটি লোকের রাজা তিনিই। তখন তাঁর হাঁচি থেকে অহংকারাসুরের জন্ম হয়। শুক্রাচার্যের পরামর্শে সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং দেবতাদের বিপদে ফেলে। গণেশ ধূম্রবর্ণ অবতারে মূষিক বাহনে এসে অহংকারাসুরকে পরাজিত করেন। এই অবতার আমাদের শেখায় যে অহংকার মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
উপসংহার
গণেশ চতুর্থীতে যখন আমরা গণেশের প্রতিমা বিসর্জন দিই, তখন আসলে আমরা আমাদের অহংকার, লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ, মোহ ও আসক্তির মতো সকল নেতিবাচক গুণ বিসর্জন দিই। গণেশের বৃহৎ উদর আমাদের সকল দুঃখ ও পাপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
- গণেশ আমার শুভকারী।