🕉️ তিলক ধারন 🕉️

#তিলক_ধারণ

সকল ভক্তের জন্য তিলক ধারণ অতি প্রয়োজনীয় একটি বিধি। নিজের সুরক্ষা এবং নিজেকে শুদ্ধ রাখা – উভয়ের জন্যই তিলকের আবশ্যকতা রয়েছে। আর কপালে শোভিত সুন্দর ও শুভ তিলকচিহ্ন জগতের কাছে একটি স্পষ্ট ঘোষণা রাখে : তিলক ধারণকারী একজন বিষ্ণুভক্ত – বৈষ্ণব। আর তিলক পরিহিত ভক্তকে দর্শন করে সাধারন মানুষেরও কৃষ্ণস্মরণ হয় এবং এভাবে তারাও পবিত্র হয়।

কখনো কখনো, কিন্তু ভক্ত পরিহাসের ভয়ে তিলক ধারণে লজ্জাবোধ করেন। কিন্তু যারা সাহস করে তিলক গ্রহণ করেন – এমনকি তাদের কর্মক্ষেত্রেও
তাঁরা অনুভব করেন তাদের প্রতি প্রযুক্ত চটুল পরিহাস ক্রমশঃ কিভাবে শ্রদ্ধায় রূপান্তরিত হচ্ছে। যেসব ভক্ত মনে করছেন যে কোনভাবেই তাঁরা প্রকাশ্যে তিলক গ্রহণ করতে পারবেন না, তাঁরা অন্ততঃপক্ষে জল – তিলক ধারণ করবেন। গোপীচন্দনের তিলক ধারণের পরিবর্তে একইরকমভাবে জল দিয়ে অদৃশ্য তিলক অঙ্কন করুন, আর সেই সাথে যথাযথ মন্ত্রগুলো উচ্চারণ করুন। এর ফলে অন্ততঃ মন্ত্রের রক্ষাকারী গুণগুলির উপকার লাভ করা যাবে।

তিলক ধারণের জন্য বিভিন্ন তিলকমাটি শাস্ত্রে অনুমোদিত হয়েছে। অধিকাংশ গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ ঈষৎ হলুদ রংবিশিষ্ট মৃত্তিকা — গোপীচন্দন তিলক ব্যবহার করেন। এই তিলকমাটি বৃন্দাবনে, নবদ্বীপে এবং ইসকন কেন্দ্রসমূহে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ স্নানের পর তিলকধারণ করতে হয়। একজন বৈষ্ণব সর্বক্ষণ তিলক পরিহিত থাকেন। তিলক পরতে হয় এভাবে : বা হাতের তালুতে একটু জল নিন। এবার ডানহাতের এক টুকরো গোপীচন্দন নিয়ে বা হাতে ঘষতে থাকুন যতকক্ষণ না তা ধারণের উপযুক্ত হয়। তিলক ধারণ করার সময় শ্রীবিষ্ণুর বারটি নাম-সমন্বিত নিম্নলিখিত মন্ত্রটি উচ্চারণ করতে হয়ঃ

ললাটে কেশবং ধ্যায়েন্নারায়ণমথোদরে।
বক্ষঃস্থলে মাধবং তু গোবিন্দং কণ্ঠ-কূপকে॥

বিষ্ণু দক্ষিণে কুক্ষৌ, বাহৌ চ মধুসূদনম।
ত্রিবিক্রিমং কন্ধরে তু, বামনং বামপাৰ্শ্বকে॥

শ্রীধরং বামবাহৌ তু হৃষীকেশঞ্চ কন্ধরে।
পৃষ্ঠে তু পদ্মনাভঞ্চ, কট্যাং দামোদরং ন্যসেৎ॥

“ললাটে তিলক ধারণ করার সময় কেশবের ধ্যান করা কর্তব্য। উদরে তিলক ধারণ করার সময় নারায়ণের ধ্যান করা কর্তব্য। বক্ষে তিলক ধারণ করার সময় মাধবের ধ্যান কর্তব্য এবং কণ্ঠে তিলক ধারণ করার সময় গোবিন্দের ধ্যান করা কর্তব্য। দক্ষিণ কুক্ষে তিলক ধারণ করার সময় বিষ্ণুর ধ্যান করা কর্তব্য। দক্ষিণ বাহুতে তিলক ধারণ করার সময় মধুসূদনের ধ্যান করা কর্তব্য। দক্ষিণ স্কন্ধে তিলক ধারণ করার সময় ত্রিবিক্রমের ধ্যান করা কর্তব্য এবং বাম কুক্ষে তিলক ধারন করার সময় বামনের ধ্যান করা কর্তব্য। বাম বাহুতে তিলক ধারণ করার সময় শ্রীধরের ধ্যান করা কর্তব্য, বাম স্কন্ধে তিলক ধারণ করার সময় হৃষীকেশের ধ্যান করা কর্তব্য; পৃষ্ঠের উপরিভাগে তিলক ধারণ করার সময় পদ্মনাভের ধ্যান করা কর্তব্য এবং পৃষ্ঠের নিম্নদেশে তিলক ধারণ করার সময় দামোদরের ধ্যান করা কর্তব্য।”
—চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলাঃ ২০-২০২ তাৎপর্য হতে উদ্ধৃত।

তিলক ধারণ পদ্ধতি

প্রথমে ডানহাতের অনামিকা (৪ র্থ আঙুল) দিয়ে একটু গোপীচন্দনের মিশ্রন নিন। এবার প্রথমে ললাটে (কপালে) তিলক অঙ্কন করুন (ছবি দেখুন)। চাপ প্রয়োগ করে লম্বভাবে দুটি রেখা ললাটে অঙ্কন করুন। রেখা টানতে হবে নাসিকা – মূল থেকে উপর দিকে কপালে (উপর থেকে নীচের দিকে নয়)। রেখাদুটিকে বেশ স্পষ্ট করার জন্য একইভাবে কয়েকবার টানতে হবে। রেখাদুটি হবে সুস্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন এবং সমান্তরাল। এবার গোপীচন্দন নাসা-মূল থেকে শুরু করে নাসিকায় দিন (এবার উপর থেকে নীচের দিকে)। অবশ্য পুরোপুরি নাসাগ্র পর্যন্ত তিলক লেপন করবেন না, আবার খুব ছোটও যেন না হয় – সঠিক দৈর্ঘ্য হল নাসিকার চার ভাগের তিন ভাগ। ললাটের রেখাদুটি এবং নাসিকার তিলক ঠিক ললাট ও নাসিকার সংযোগস্থানে মিলিত হবে। আয়না দেখে এটা ঠিক করে নিন। তিলক খুব সযত্নে পরিচ্ছন্নভাবে ধারণ করতে হয়।

তিলক ধারনের সময় নীচের মন্ত্রগুলো জপ করতে হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশে তিলকাঙ্কনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুনিদিষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। নীচের ক্রম অনুসারে বিভিন্ন অঙ্গে তিলক ধারণ করতে হয়ঃ

১। ললাটে –ওঁ কেশবায় নমঃ।
২। উদরে –ওঁ নারায়নায় নমঃ।
৩। বক্ষস্থলে –ওঁ মাধবায় নমঃ।
৪। কণ্ঠে –ওঁ গোবিন্দায় নমঃ।
৫। দক্ষিণ পার্শ্বে –ওঁ বিষ্ণবে নমঃ।
৬। দক্ষিণ বাহুতে –ওঁ মধুসূদনায় নমঃ।
৭। দক্ষিণ স্কন্ধে –ওঁ ত্রিবিক্রমায় নমঃ।
৮। বাম পার্শ্বে –ওঁ বামনায় নমঃ।
৯। বাম বাহুতে –ওঁ শ্রীধরায় নমঃ।
১০। বাম স্কন্ধ –ওঁ হৃষীকেশায় নমঃ।
১১। পৃষ্ঠে –ওঁ পদ্মানাভায় নমঃ।
১২। কটিতে –ওঁ দামোদরায় নমঃ।

ডানহাতের অনামিকা (চতুর্থ আঙুল) দিয়ে তিলক ধারণ করতে হয়। ডানহাতের বাহুতে তিলক দেওয়ার জন্য বাম হাতের অনামিকা ব্যবহার করতে হবে। সর্বাঙ্গে তিলকাঙ্কনের পর বাম হাতের তালুর অবশিষ্ট তিলক- মিশ্রন সামান্য জলে ধুয়ে ঐ জল “ওঁ বাসুদেবায় নমঃ” উচ্চারণপূর্বক মস্তকে দিতে হবে।
#সংগৃহীত
PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.

🍂🍁গোত্র সম্পর্কিত আলোচনা🍁🍂

 

 

 

 

 

🔻গোত্র শব্দের অর্থ কুল বা বংশ।সনাতন ধর্মে গোত্র মানে একই পিতার ঔরসজাত সন্তান-সন্ততি দ্বারা সৃষ্ট বংশ পরম্পরা।গো-শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গম্-ধাতু থেকে যার অর্থ- গতি। আর ‘ত্র’ উতপত্তি হয়েছে ত্রৈ-ধাতু থেকে, মানে হলো ত্রাণ করা। তাই গোত্র মানে দাঁড়ায় বংশের ধারা বা গতি যাঁর মাধ্যমে রক্ষিত হয় সেই স্মরনীয় পিতৃপুরুষ। তিনিই গোত্র পিতা।সনাতন ধর্মের বৈশিষ্ট্য হলো,এ ধর্মের বংশ রক্ষার ধারায় ঋষিগণ সম্পৃক্ত ছিলেন।এই একেকজন ঋষির বংশ পরম্পরা তাদের নামে এক একটি গোত্র হিসেবে পরিচিত লাভ করে।

 

পূজা, যজ্ঞ কিংবা বিবাহ যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই গোত্রের নাম জিজ্ঞেস করা হলে নামটা অবলীলায় মুখ থেকে নির্গত হলেও তা কেবল নামসর্বস্বই। এর বাইরে গোত্র সম্বন্ধে খুব কম লোকরই জানা। পারিবারিক পরম্পরায় শুধু নামটিই প্রবাহিত হয়ে আসছে, কিন্তু এর উৎস সম্বন্ধে অধিকাংশই অজ্ঞ।

 

 

 

কীভাবে আমাদের নামের সাথে এই গোত্রটি যুক্ত হয়ে গেল? এর নেপথ্যে কী?

গোত্র সম্পর্কে জানতে হলে এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এর ইতিহাস জানতে হবে। ভগবানের নির্দেশে ব্রহ্মা সৃষ্টি কার্য শুরু করলেন। ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন সৃষ্টি বিস্তারের লক্ষ্যে ।তাদের সৃষ্টি করা হলেও ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয়ে মোক্ষ লাভ করে।মোক্ষনিষ্ঠ কুমারেরা সৃষ্টি বিস্তারে কাজ করার অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন।

 

ব্রহ্মা যখন দেখলেন যে, মহাবীর্যবান ঋষিদের উপস্থিতি সত্ত্বেও সৃষ্টির বিস্তার তথা মনুষ্যকুল পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তখন তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি চিন্তা করলেন, নিজের দেহ থেকে এভাবে সৃষ্টি না করে, নারী-পুরুষের মাধ্যমে সংসার সৃষ্টি হোক। তখন তাঁরা দেহ থেকে প্রান পেয়েছিল আদি মানব পিতা মাতার, তাঁরা হলেন মনু ও শতরূপা।

 

মনু তাঁর জেষ্ঠ্য কন্যা আকুতিকে রুচি নামক ঋষিকে দান করেন এবং কনিষ্ঠা কন্যা প্রসূতিকে দক্ষের নিকট দান করেন। তাঁদের দ্বারাই সমগ্র জগৎ জনসংখ্যায় পূর্ণ হয়েছে। ব্রহ্মা থেকে সৃষ্ট ঋষিদের থেকেই বিভিন্ন গোত্রের প্রবর্তন হয়েছে।

 

 

 

গোত্র প্রসঙ্গে ভারতীয় গণিতবিদ বৌধায়ন (খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০ শতক) এর মত নিম্নরূপ-

 

 

 

বিশ্বামিত্রো জমদগ্নিভরদ্বাজোত্থ গৌতমঃ।

 

অত্রিবশিষ্ঠঃ কশ্যপ ইত্যেতে সপ্তঋষয়।

 

সপ্তানাং ঋষিনামগস্ত্যাষ্টমানাং যদপত্যং তদগোত্রম্।।

 

 

 

অর্থাৎ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ,ও কশ্যপ এই সাতজন মুনির পুত্র ও পৌত্র প্রভৃতি অপত্যগণের মধ্যে যিনি ঋষি হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে, তাঁর নামেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গোত্র ।

 

বৌধায়নসূত্রে বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ ও কশ্যপ এই সাতজন ঋষিই আদি গোত্রকার বলে নির্দিষ্ট আছেন। সাতজন ঋষি থেকে প্রবাহিত গোত্র ব্যতিত আরও কিছু গোত্রের নামও শোনা যায়। তবে এর কারণ হচ্ছে একই গোত্রদ্ভুত কোনো প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নাম অনুসারে পরবর্তী কোনো সময়ে ঐ প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নামে গোত্র পরিচয় দেওয়া। যেমন কাশ্যপ গোত্রের বংশক্রমে যদি কোনো ব্যক্তি প্রসিদ্ধ হয় এবং পরবর্তীতে যদি সেই প্রসিদ্ধ ব্যক্তির নামে গোত্র পরিচয় হয়ে থাকে । এইরূপ আরও কিছু গোত্র আছে যেমন শাণ্ডিল্য,অগ্যস্ত,কাত্যায়ন, বাৎস্য, সার্বন, কৌশিক, মৌদগল্য, আলম্যান, পরাশর, অত্রি, রোহিত, বৃহস্পতি, গর্গ ইত্যাদি।

 

 

 

প্রায়ই শোনা যায়, একই গোত্রে কেন বিবাহ করা যায়্না?জেনে নেয়া যাক এক্ষেত্রে শাস্ত্রে কী বলা হয়েছে?

একটি বংশের রক্ত ধারাবাহিকভাবে প্রভাবিত হয় পুরুষ পরম্পরায়। বৈদিক যুগ থেকেই একই গোত্রে বিবাহের নিষেধ আছে।কেননা সমগোত্র মানে বর ও কনের কোনো না কোনো পিতৃপুরুষ একই পিতার থেকে এসেছে। রক্তধারা যেহেতু পুরুষ পরম্পরায় প্রবাহিত হয় সুতরাং বংশের রক্তের ধারক বাহক হচ্ছে পুরুষ।এজন্য একই বংশের ছেলে মেয়ের মধ্যে বিবাহ বন্ধন হতো না।কারণ হিসেবে বৈদিক শাস্ত্রসমূহ বিশেষ করে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, একই রক্তের সম্পর্কের কারো সাথে বিবাহ হলে সন্তান বিকলাঙ্গ, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী, মেধা ও বুদ্ধিহীন হয়। শিশু নানা রোগে জরাজীর্ণ হয়ে থাকে। তবে একান্তই প্রয়োজন হলে যেমন পাত্র-পাত্রী না পাওয়া গেলে ১৪ পুরুষ পেরিয়ে গেলে তখন বিবাহ করা যেতে পারে। তবে তা যথাসম্ভব এড়িয়ে চললেই ভালো।

 

 

 

মনুসংহিতায় (মনুসংহিতা ৩/৫-৬) এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–

 

 

 

অসপিন্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।

 

সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।

 

 

 

অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ সপ্তপুরুষ পর্যন্ত মাতামহাদি বংশজাত না হয় ও মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয় এবং পিতার সগোত্রা বা সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয় এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের বিবাহের যোগ্য বলে জানবে।

 

 

 

বৈদিক শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করছেন-

 

তারা বলছেন, নিকটাত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের পরিণামে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ‍”দ্য ল্যানসেট” সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন।

((সংগৃহীত))

PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.

#স্বামী পরমানন্দ এর জীবনী (তৃতীয় পর্ব)

 

 

সুরেশচন্দ্র যখন মঠে আসিয়া যোগ দিলেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ষোল বৎসর ৷ এত ছোট ছেলেকে মঠে যোগদান করিতে দেওয়া সমীচীন হইবে কিনা, ইহা লইয়া মঠের সাধুরা একটু সমস্যায় পড়িয়াছিলেন ৷ বালক সুরেশচন্দ্রও ইহাতে বড়ই নিরাশ হইয়া, মঠে প্রথম রাত্রি বিনিদ্র যাপন করিলেন ৷ মন তাঁহার দুঃখে ও অভিমানে ভারাক্রান্ত হইয়াছিল ৷ অবশেষে তাঁহার বালক বয়সই তাঁহাকে জীবনের পরমবাঞ্ছিত পথে চলিতে বাধা সৃষ্টি করিবে !

 

যাহা হউক, দুশ্চিন্তার নিশা অবসান হইলে, মলিনমুখে তিনি অপেক্ষায় বসিয়া থাকিলেন ৷ মনে মনে শ্রীভগবানের কাছে কাতরে জানাইতেছিলেন — “হে ঠাকুর তোমার অভয় আশ্রয়ে একটু স্থান দাও ৷ আমি ছোট বলিয়াই কি তোমার চরণে ঠাঁই পাইব না ? তুমি কি শুধু বড়দের জন্য, ছোটদের জন্য নও ?”

 

এমন সময়ে সহসা স্বামীজী তাঁহাকে ডাক দিলেন — “হ্যাঁরে, তুই গান গাইতে জানিস ? গা তো একটা গান ৷” সুরেশের বুক হইতে যেন পাষাণভার খসিয়া পড়িল ৷ স্বামীজীর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিয়াই, প্রাণ ঢালিয়া গান ধরিলেন —

 

“চিনি না জানি না বুঝি না তাঁহারে, তথাপি তাঁহারে চাই ৷

(আমি) সজ্ঞানে অজ্ঞানে পরানের টানে, তাঁর পানে ছুটে যাই ৷৷

দিগন্ত প্রসার অনন্ত আঁধার, আর কোথা কিছু নাই ৷

(আমি) তাহার ভিতরে মৃদু মধুস্বরে কে ডাকে শুনিতে পাই ৷৷

আঁধারে নামিয়া আঁধার ঠেলিয়া না বুঝিয়া চলি তাই ৷

আছেন জননী, এই মাত্র জানি, আর কোন জ্ঞান নাই ৷৷

কিবা তাঁর নাম, কোথা তাঁর ধাম, কে জানে কারে শুধাই ৷

না জানি সন্ধান, যোগ ধ্যান জ্ঞান, ঘ্রাণে মত্ত হয়ে ধাই ৷৷”

 

স্বামীজী অদ্ভুত এক কৌশলে সুরেশের মনের কথাগুলি জানিয়া লইয়াছিলেন ৷ হৃদয়ের সবটুকু ভাবের সহিত চোখের জল মিশাইয়া সুরেশও স্বামীজীর কাছে এইভাবেই তাঁহার প্রাণের কথা নিবেদন করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন ৷ স্বামীজী বালকের আর্তিতে প্রসন্ন হইয়া, তাঁহাকে মঠে থাকিবার অনুমতি প্রদান করিলেন এবং গুরুভ্রাতাদের ডাকিয়া তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিলেন, “এই ছেলেটি মঠে থাকবে ৷”

 

স্বামীজীর অনুমতি হওয়াতে, অন্যান্য সকলেই নিশ্চিন্ত হইয়া, বালক সুরেশকে পরম-স্নেহভরে মঠে থাকিবার ব্যবস্থাদি সব করিয়া দিলেন ৷ স্বামীজীর পদপ্রান্তে স্থান পাইয়া, সুরেশও সেই দিন হইতে নূতন জীবন লাভ করিলেন ৷ উদ্বেগ-সমস্যা ও ভাবনা-চিন্তার অবসান হওয়াতে বালকের মুখে চোখে অদ্ভুত এক মাধুর্য ফুটিয়া উঠিয়াছিল ৷ মনে হইতেছিল, শীতের জড়তাশেষে সদ্যসমাগত বসন্ত-ঋতুর মলয়-স্পর্শে তাঁহাতে যেন নবীন প্রাণের সঞ্চার হইয়াছে ৷ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাই তাঁহাকে আদর করিয়া নাম দিলেন ‘বসন্ত’ ৷

 

এই নামকরণের পশ্চাতে সুরেশের প্রতি মহারাজের একটি স্নেহাশীর্বাদও প্রচ্ছন্ন ছিল ৷ ব্রহ্মানন্দজী বলিতেন, “শঙ্কর কি বলেছেন জানিস তো ? তিনি বলেছেন, ‘শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো, বসন্ত-বল্লোকহিতং চরন্তঃ ৷’ ‘শান্ত মহান সাধুব্যক্তিরা সংসারে থেকে বসন্তঋতুর মতো লোককল্যাণে নিরত থাকেন — তাঁরা যেখানে যান, সেখানেই বসন্তসমাগমের আনন্দ’ ৷”

( চলবে )

  1. ((সংগৃহীত)) PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.