<Sri Yoga Center Kunarpur – Vedic Yoga, Indology & Cultural Research ="https://gmpg.org/xfn/11"> Sri Yoga Center Kunarpur – Vedic Yoga, Indology & Cultural Research ধার্মিক - Sri Yoga Center Ashram's Blog - Page 16

আদিশক্তি

ধূমাবতী —

ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার সপ্তম মহাবিদ্যা। শাস্ত্রে অক্ষয় তৃতীয়ার রাত্রিকে দারুণরাত্রি বলা হয় এবং মহাবিদ্যা ধূমাবতীর আবির্ভাবতিথি রূপে গণ্য করা হয়।

মা ধূমাবতী কেতুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নিষ্ঠাপূর্বক সাধনায় তিনি বিপুল সুফলদায়িনী। মা ধূমাবতীর কৃপালাভ করতে পারলে সাধক সফলতার শিখরে পৌঁছে যায়।

দশমহাবিদ‍্যা দেবীদের মধ্যে সপ্তমরূপ হলো মা ধূমাবতী। আদ‍্যাশক্তির এই রূপের নেপথ্যেও আছে হরগৌরীর দাম্পত‍্যকলহ।

মহাদেব আপনভোলা। তিনি সংসারযাপন করেন অথচ সংসারের কর্মে তার অন‍্যমনস্কতা প্রকট। সংসারের কোনো খেয়াল তার নেই। সে অনন্ত ধ‍্যানে মগ্ন। এদিকে কৈলাসের রন্ধনশালায় যে খাদ‍্যসংকট দেখা দিয়েছে, তা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। মহাদেবের এই নিয়ে কিছুমাত্র ভাবনাও নেই কারণ তিনি জানেন পার্বতী যে অন্নপূর্ণা, তার হেঁশেল শূণ্য হতে পারেনা। কিন্তু পার্বতী যে মহামায়াও, তা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন।

পার্বতী সে বিস্মৃতির প্রতিকার চাইলেন মনে মনে। মহাদেবী বারংবার মহাদেব কে খাদ‍্য আনয়নের অনুরোধ জানান। বারংবার স্বামীকে তার ক্ষুধাগ্নি নির্বাপনের জন্য বলতে লাগলেন। কিন্তু মহেশ্বর তার অনুরোধ কে আমল দিলেননা। তিনি অবিরত থাকলেন তার ধ‍্যানে।

এতো অনুরোধের পরেও স্বামী তার কথায় কর্ণপাত না করায় দেবী ক্রোধান্বিতা হয়ে উঠলেন। দেবীর শরীরের আকৃতি বর্ধিত হতে থাকলো এবং একসময় তা গগনচুম্বী হলো। অতঃপর দেবী ধ‍্যানমগ্ন মহাদেবকে তার বৃহৎ অলক্তচর্চিত অঞ্জলিপুটে ধারণ করলেন এবং স্বয়ং মহাদেবকে ভক্ষণ করলেন।

তৎক্ষণাৎ পার্বতীর বদ্ধবেণী উন্মুক্ত হয়ে তিনি হলেন আলুলায়িতকুন্তলা। পরনের রক্তবস্ত্র বদলে গেল সাদাকাপড়ে। আভরণের জাজ্জ্বল‍্যতা রূপান্তরিত হলো মলিনতায়। পরমতেজস্বী মহাদেবকে ভক্ষণ করার জন্য দেবীর গাত্র থেকে নির্গত হতে থাকলো ধূমরাশি। দেবী হয়ে উঠলেন ধূম্রবর্ণা ধূমাবতী। দেবীর ছায়া সমগ্র চরাচরে এসে পরলো। চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল।

বিশ্বচরাচর কম্পিত হয়ে উঠলো এই কান্ডে। ব্রহ্মাণ্ড স্থির হয়ে গেল। মহাকালের অস্তিত্ব নেই, তাই কাল অর্থাৎ সময় রোহিত হয়ে গেল।

এমতাবস্থায় ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু এলেন দেবীর পাদদেশে এবং করুণ মিনতি জ্ঞাপন করতে থাকলেন, যাতে তিনি পূনরায় পূনর্রূপে প্রত‍্যাবর্তন করেন। ত্রিদেব এবং মহামায়া কালচক্রের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। সময় স্থবির হয়ে গেলেও এনারা তার অধীনস্থ নন।

সময়ের তিনটি পর্যায় — অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সময় থমকে গেলে এই তিনটি পর্যায়ের চলনশক্তি লোপ পায়। আবার মহাদেব এবং মহাদেবীর মিলন ছাড়া ঐ চলনশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করাও অসম্ভব। তাই নিজকর্মে অনুতপ্ত ধূমাবতী ধ‍্যানমগ্না হলেন।

মহাদেবকে ভক্ষণ করা যতোটা প্রাঞ্জল ছিল, তাকে জঠরমুক্ত করা তার কাছে ততোটা প্রাঞ্জল নয়। দেবী ধ‍্যানযোগে মহাদেবেরই স্মরণাপন্ন হলেন। মহাদেবের কাছে ধ‍্যানযোগে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন দেবী।

ধূমাবতীর জহরস্থিত মহাদেব, ধূমাবতীর অনুতাপ কে লঘু করলেন এবং বোঝালেন, তিনি কখনও মহাদেবের পূর্ণধ্বংস করতে পারবেন না। দেবী তার অস্তিত্ব কে কেবল অস্বীকার করেছে মাত্র, তাই তিনি বিধবা, তবে মহাদেব তার মধ্যেই নিহিত আছেন। জন্ম মৃত্যু একটা ভ্রম মাত্র। মহাকাল এবং মহাকালী এই ভ্রমের ঊর্ধ্বে। মহাকাল ও মহাকালী পরস্পরের পরিপূরক। তিনি শিবের ধ্বংস করেননি, পরন্তু শিবের নবজন্ম দিচ্ছেন দেবী।

এরূপ স্তোকবাক‍্যে শান্ত হয়ে দেবী তার জঠরের সকল শক্তি কে ঊর্ধগামী করলেন। সেই ঊর্ধগামী স্রোতে আবির্ভূত হলেন দেবাদিদেব মহাদেব।

ভগবান শঙ্কর দেবী পার্বতীকে বললেন —
তোমার সুন্দর চেহারাখানা ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়ায় তোমাকে ধূমাবতী বা ধূম্রা বলে ডাকা হবে।

ধূমাবতী দীর্ঘকায়া। লম্বিত কুচদ্বয়শোভিতা। ভীষণ দন্তরাশিযুক্ত মুখমণ্ডল ভয়াবহ। ধুম্রবর্ণা কুটিলনয়না সর্বদা ক্ষুধাতুরা শীর্ণকায়া দেবী ধুম্রাচ্ছন্ন মলিনবসন পরিহিতা অবস্থায় শূর্পহস্তে কাকধ্বজ রথে আসীনা।

দশমহাবিদ্যার মধ্যে একমাত্র তিনিই ভৈরবরহিতা। স্বয়ংসম্পূর্ণা। মা ধূমাবতী মহাশক্তি একলা এবং তিনি স্বয়ং নিয়ন্ত্রিতা। তার কোনও স্বামী বা প্ৰভু নেই। এইজন্য তাকে বিধবাররূপে কল্পনা করা হয়।

দুর্গাসপ্তশতী অনুসারে ইনিই সেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে —
“যে আমাকে যুদ্ধে পরাস্ত করে আমার গর্ব চূৰ্ণ করবে, সেই আমার পতি হবে। সেই প্রতিজ্ঞা কেউ ভাঙ্গতে পারেনি, তাই তিনি কুমারী। ধন বা পতি না থাকাতে অথবা নিজের স্বামী মহাদেবকে গিলে ফেলায় ইনি বিধবা ।

নারদপাঞ্চরাত্র অনুযায়ী ইনি নিজ শরীর থেকে দেবী উগ্ৰচণ্ডিকাকে প্রকাশিত করেছিলেন যিনি শত শত শকুনের মত আওয়াজ করতেন। শিবকে গিলে ফেলার অর্থ হল তার স্বামীত্বকে অস্বীকার। অসুরদের কাঁচামাংসে তার অঙ্গভূত শৃগালেরা তৃপ্ত হল, এটাই হল এর ক্ষুধার তত্ত্ব।

ধোঁয়ারূপে ইনি বিবর্ণা, চঞ্চলা, কৃষ্ণবর্ণা, অপরিচ্ছন্ন বস্ত্রপরিহিতা, মুক্তকেশী, বিধবা, কাকধ্বজ চিহ্নিত রথারূঢ়া, হাতে কুলা, ক্ষুধাপিপাসায় ব্যাকুল মুখ, চােখ দুটি নির্মম দৃষ্টিদায়িনী।

স্বতন্ত্রতন্ত্র অনুসারে সতীদেবী যখন দক্ষযজ্ঞে যোগাগ্নিতে নিজেকে ভস্মীভূত করেছিলেন, তখন সেই অগ্নি থেকে যে ধোঁয়া বেরিয়েছিল তার থেকেই ধূমাবতী বিগ্রহ প্রকট হয়েছিলেন।

দেবীধূমাবতীর উপাসনা — বিপদনাশ, রোগমুক্তি, যুদ্ধজয়, উচাটন ও মারণাদি কর্মে সিদ্ধিলাভ এর জন্য করা হয়।

শাক্তপ্রমোদে বর্ণনা আছে যে এর উপাসকের উপর অশুভ, ক্ষতিকর ক্রিয়ার কোনও প্রভাব পড়েনা।

সব রোগ, দুঃখের অধিপতি হচ্ছেন চার দেবতা। জ্বর, উন্মাদ ও প্রদাহ হয় রূদ্রেরকোপে, মূর্চ্ছা, বিকলাঙ্গতা যমের কোপে, ধূলি (ধূসরতা-রূক্ষ- কৰ্কশতা) গ্রন্থিরোগ (গাটঁফোলা) শক্তিলোপ বা কোন অঙ্গ অবশ হয়ে যাওয়া-পক্ষাঘাত এবং শোক, কলহ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা ইত্যাদি নির্ধতির কোপের দরুন হয়।

শতপথব্রাহ্মন অনুসারে ধূমাবতী ও নির্ধতি একই। ইনি লক্ষ্মীর জ্যেষ্ঠা, তাই জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রে জন্মান মানুষ আজীবন দুঃখভোগ করে।

তন্ত্রগ্রন্থ অনুসারে ধূমাবতী আর উগ্ৰতারা একই, ধূম্রা হওয়ার জন্য ধূমাবতী নাম।

শ্ৰীশ্ৰীচণ্ডীতে বাভ্রবী ও তামসী নামে এর ব্যাখা আছে। ইনি তুষ্ট হলে রোগ এবং শোক নাশ করেন আর কুপিত হলে সমস্ত সুখ ঐশ্বর্য এবং ঈপ্সিত বস্তু নষ্ট করে দেন। এর শরনাগতি নিলে বিপত্তিনাশ এবং সম্পত্তি প্রাপ্তি হয়।

ঋগ্বেদের রাত্রিসূক্তে একে নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুতরা’। সুতরার অর্থ সুখপূর্বক তারণের উপযুক্ত। তাঁরা বা তারিনী এর পূৰ্বরূপ বলে মনে করা হয়। এইজন্য আগমশাস্ত্ৰে অভাব, সঙ্কটনাশ করে সুখদায়িনী বিভূতিরূপে ইনি।

ধূমাবতীর স্তব বন্দনা —

ঠং ঠং ঠং ঠং মনুপ্রীতিং ঠঃ ঠঃ মন্ত্রস্বরূপিণীম্ ।

থাং থীং থূং থেং মন্ত্ররূপাং থৈং থৌং থং থঃ স্বরূপিণীম্ ।

টণ্টণ্টণ্টণ্টটণ্টাণ্রকটটমটমা নাটঘণ্টাং বহন্তী ।

স্তব অনুযায়ী দেবী ধূমাবতী নাট্যনর্ত্তনাদি ললিতকলার এক অধিষ্ঠাত্রী দেবী।

নর্ত্তকীনটনপ্রীতাং নাট্যকর্মবিবর্দ্ধিনীম্ ।

আবার স্তবমন্ত্রে
“ফেত্কারিগণসংসেব্যাং সেবে ধূমাবতীমহম্” থেকে জানা যায় দেবী ধূমাবতী ফেৎকারীগণের দ্বারা সেবিতা।

মাতৃবন্দনার আদিপর্বের সেই ধূসর অতীতেরই সংসর্গ আছে দেবী ধূমাবতীর মধ্যে।

লোলম্মুণ্ডাগ্রমালা ললহলহলহা লোললোলাগ্রবাচং চর্বন্তীচণ্ডমুণ্ডং মটমটমটিতে চর্যষন্তী পুনাতু ॥

অর্থাৎ, ধূমাবতী চণ্ডমুণ্ডের অস্থি মটমট করে চর্বণ করেন।

ধূমাবতী মাতৃকা উপাসকদের কাছে সেই বিপদহারিণী মাতৃকা; যিনি একাধারে শত্রুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা ক্রূরকুটিলা ভীষণা আবার স্বভূমির ললিতকলার প্রধান রক্ষয়িত্রী।

মা ধূমাবতী প্রণাম মন্ত্র —

ॐ বিবর্ণা চঞ্চলা রুষ্টা দীর্ঘা চ মলিনাম্বরা ।
বিব‍র্ণাকুন্তলা রুক্ষা বিধবা বিরলদ্বিজা ॥

.

জয় মা

.

(সংগৃহীত)TAKEN  FROM WHAT’SAPP

Published by SHRUTI ADHYA KUNDU

MARKETING OFFICER OF SYCN

জগন্নাথ দেব

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর অনেকদিন কেটে গেছে। শ্রীকৃষ্ণ তখন দ্বারকায়। একদিন তিনি গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। তাঁর রাঙা চরণকে টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসল এক শবর। নাম তার জরা। বাণের আঘাতেই অবশেষে প্রাণ হারালেন কৃষ্ণ। অপঘাতে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবরপেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ তো পুড়ছে না !
তখনই হল দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। আর তাকে লক্ষ করে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলল অনার্য সেই শবর – জরা। শেষ অবধি তার বাণেই মৃত্যু হল ভগবানের !
দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলা। অবশেষে এখানেই ঠাকুরকে স্বপ্ন দেখল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে এখন থেকে তোর বংশধর, শবরদের হাতেই পুজো নেব আমি’। তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকলেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ।
এরপর এলো কলি যুগ। কলিঙ্গের রাজা তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব। তিনি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সেই উদ্দেশ্যে তিনি গড়ে তুললেন একটি মন্দির, শ্রীক্ষেত্রে। এখন আমরা তাকে চিনি জগন্নাথধাম রূপে। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই।
রাজসভায় একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন নীলমাধবের কথা। ইনি নাকি বিষ্ণুরই এক রূপ। অমনি চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা। এঁদের প্রত্যেকেই ধার্মিক ব্রাহ্মণতনয়। বাকিরা খালি হাতে ফিরে এলেও, ফিরলেন না একজন – বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা ললিতা। নিয়ে এলেন তাদের বাড়ি।
ললিতা শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা। ললিতার প্রেমে পড়লেন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের। বিয়ের পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য কোথাও উধাও হয়ে যান, আবার ফিরে আসেন। কোথায় যান বিশ্ববসু ! স্ত্রীকে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পূজো করতে যান শবররাজ বিশ্ববসু।
নীলমাধবের সন্ধান যখন পাওয়া গেছে, তখন আর ছাড়ার নয়। অমনি বিদ্যাপতি বায়না ধরলেন, তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে। বিশ্ববসু প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে মত।দিলেন। তবে শর্তসাপেক্ষে। বিগ্রহ পর্যন্ত চোখ বেঁধে যেতে হবে বিদ্যাপতিকে। জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোন ভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি ছিলেন না বিশ্ববসু।
বিদ্যাপতিও ছাড়ার পাত্র নন। চোখ বাঁধা অবস্থায় যাওয়ার সময় তিনি গোটা পথটায় সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। যথাস্থানে পৌঁছে যখন তিনি দর্শন পেলেন নীলমাধবের, তখন তাঁর প্রাণ আনন্দে ভরে উঠল।
বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পূজোয় বসলেন, অমনি দৈববাণী হল, ‘এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহাউপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’
ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ। ইষ্টদেবতাকে হারাবার দুঃখে বন্দী করলেন বিদ্যাপতিকে। কিন্তু কন্যা ললিতার বারবার কাকুতি মিনতিতে বাধ্য হলেন জামাতাকে মুক্ত করতে। বিদ্যাপতিও সঙ্গে সঙ্গে এই খবর পৌঁছে দিলেন রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন মহানন্দে জঙ্গলের মধ্যে সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন ঠাকুরকে সাড়ম্বরে রাজপ্রাসাদে আনতে। কিন্তু একি, নীলমাধব কোথায় !
আটক হলেন শবররাজ। তখন দৈববাণী হল যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে কাঠ। সেই থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার। হাজার হাতি, ঘোড়া, সেপাইসাস্ত্রী, লোকলস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। শেষে কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। জগন্নাথের কাছে ব্রাহ্মণ-শবর কোনও ভেদাভেদ নেই যে !
মহারাজ তাঁর কারিগরদের লাগালেন মূর্তি গড়তে। কিন্তু সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। তা হলে উপায় ! মূর্তি গড়বে কে ! মহারাজের আকুলতা দেখে বৃদ্ধের বেশে এবার হাজির হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। তিনিই গড়বেন মূর্তি। তবে শর্ত একটাই। একুশদিন আগে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে।
শুরু হল কাজ। ইন্দ্রদ্যুম্নের রাণি গুন্ডিচা রোজই রুদ্ধ দুয়ারে কান পেতে শোনেন কাঠ কাটার ঠক্ ঠক্ শব্দ। চোদ্দদিন পর হঠাৎ রাণি দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ নিস্তব্ধ। কী হল ! কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রাণি মহারাজকে জানাতেই ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা। ভেতরে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও, পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি। তাদের হাত, পা কিছুই গড়া হয় নি।
গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন ভেবে দুঃখে ভেঙে পড়লেন রাজা। তখন তাঁকে স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন যে এমনটা আগে থেকেই পুনর্নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের বলভদ্রদেবের বিগ্রহ তারা যন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত, সুভদ্রা প্রতিষ্ঠিতা ভুবনেশ্বরী যন্ত্রের উপর এবং জগন্নাথদেব প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণাকালীর যন্ত্রের উপর।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন, ‘কলিতে জগন্নাথের মহাপ্রসাদ সাক্ষাৎ ব্রহ্ম’।
.
শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের প্রণাম মন্ত্রঃ —
ॐ নীলাচলনিবাসায় নিত্যায় পরমাত্মনে ।
বলভদ্র সুভদ্রাভ্যাং জগন্নাথায় তে নমঃ ।।
— পরমাত্মা স্বরূপ যাঁরা নিত্যকাল নীলাচলে বসবাস করেন, সেই বলভদ্রদেব, সুভদ্রা ও জগন্নাথদেব কে প্রণতি নিবেদন করি।
জয় জগন্নাথ।
.
(সংগৃহীত)

উদ্ধব গীতা

উদ্ধব গীতা –ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জীবনের অন্তিম মহা উপদেশ ভাগবতের একাদশ স্কন্দ্বের সপ্তম অধ্যায় থেকে উনত্রিশ অধ্যায় পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। এই ২৩টি অধ্যায়কে “উদ্ধব গীতা” বলা হয়।ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সারথি ছিলেন উদ্ভব। শ্রী কৃষ্ণ যখন গোলক ধামে ফিরে যেতে মনস্থ করলেন তখন তিনি তাঁর সমস্ত ভক্তের মনোকামনা পূর্ণ করছেন। কিন্তু শুধু উদ্ভব ছিলেন নীরব আসক্তিহীন। উদ্ভব কিছু চাইছে না দেখে ভগবান তাকে কিছু চাইতে বললেন। উদ্ভব বলল প্রভু আমি তো আপনার কাছ থেকে কোনদিন কিছু চাইনি তবে আজ কেন চাইব ? ভগবান বললেন উদ্ভব আজ তুমি না চাইলেও আমি তোমাকে কিছু দেব। না দিলে অবিচার হবে। উদ্ভব বলল, “বেশ তো যদি কিছু দিতেই চান তবে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন।” “কি প্রশ্ন বলো উদ্ভব ? আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর অবশ্য দেব”। উদ্ভব বলল “প্রভু আপনি তো পাণ্ডব দের পরম মিত্র ছিলেন তবুও তাদের সবথেকে বড় বিপদে আপনি তাদের পাশে কেন থাকেন নি ? আপনি তো দীনবন্ধু। আপনার পরম মিত্রদের পাশে দাঁড়ালে হয়তো কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ আপনি আটকে দিতে পারতেন। মহারাজ যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলায় হেরে যাচ্ছিলেন তখন আপনি কেন যাননি তাঁকে সাহায্য করতে ? আপনি কেন দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণে বাধা দিলেন না ?” এই প্রশ্ন শুনে ভগবান বললেন “উদ্ভব আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব তবে তার আগে তোমাকে জানতে হবে ভক্ত, ভগবান ও বন্ধুত্ব পালনের কিছু নিয়ম। যখন কোন ভক্ত আমাকে বন্ধু বলে ভাবে তখন সে মনে করে আমি তার সাথে সর্বদা থাকি। তখন সেই ভক্ত তার সব কাজের সাক্ষী মানে আমাকে। আমাকে সাক্ষী করলে কখনও কোন ভক্ত কোন খারাপ কর্ম করতেই পারে না। কারণ আমি তার সাথে সর্বদা থেকে তাকে কুকর্ম থেকে বিরত রাখি। কিন্তু যখন সেই ভক্ত আমার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে অহংকারের ফলে আমার সঙ্গ ত্যাগ করে তখন আমি নিরুপায় হয়ে যাই। আমার থেকে দুরত্ব বাড়লেই তখন সে পাপ করতে শুরু করে। অহংকারের প্রাচীর তুলে সে তখন আমাকে আড়াল করে রাখে। অসহায়ের মত দেখা ছাড়া আমার কিছুই করার থাকে না। কারণ মানুষের কর্মের ওপর ভগবানের কোন অধিকার নেই। এটাই জগতের নিয়ম। মানুষ স্বাধীন জীব। শুধু মানুষ কেন জগতের সমস্ত জীবই স্বাধীন। মানুষ তো আরও স্বতন্ত্র। তার বিবেক, বুদ্ধি, মনুষ্যত্ব আছে। তাই তার স্বাধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ ভগবান ও করতে পারেন না। মোহ, মায়া ও অহংকারের বশীভূত হয়ে বাসনাসক্ত মানুষ পাপের বোঝা বাড়িয়ে চলে। এবার তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব উদ্ভব। যুধিষ্ঠির যখন পাশা খেলার জন্য শকুনির আমণ্ত্রণ গ্রহণ করল তখন সে আমাকে জানায় নি। কারণ সে জানত পাশা খেলায় আমি বাধা দেব। যখন আমি জানতে পারলাম সেই কথা তখন সে আমাকে দিব্যি দিয়ে আমাকে অসহায় করে দিল। যুধিষ্ঠির অহংকার ও অতি আত্মবিশ্বাসের দ্বারা চালিত হয়ে পাশা খেলতে গেল। যুধিষ্ঠির আমাকে দ্যূত ক্রীড়াস্থলে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছিল। ভাবো তো উদ্ভব যদি শকূনির সাথে আমি পাশা খেলতাম তাহলে খেলার পরিণাম কি হতো ? পঞ্চ পাণ্ডব কি সব কিছু হারিয়ে নিলামে উঠত ? দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ কি হতো ? দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর কক্ষে গিয়ে তাকে অপমান করতে লাগল, তার কেশ আকর্ষণ করে তাকে সভাকক্ষে টেনে নিয়ে এল তখনও দ্রৌপদী আমাকে ডাকেনি। আমার কথা তখন তার মনেই ছিল না। যখন শেষ মুহূর্তে সম্মান রক্ষার জন্য এক ফালি বস্ত্র অঙ্গে ছিল না তখন সে আমাকে স্মরণ করল। আমার প্রিয় সখী আমাকে স্মরণ করছে এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে। ডাকা মাত্রই আমি দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে তার সম্মান রক্ষা করেছি। অর্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব যখন তারা সবাই দুর্যোধনের কাছে নিলাম হয়ে যাচ্ছিল তখন তারা কেউ আমাকে সাহায্যের জন্য ডাকেনি। দ্রৌপদীর স্মরণ মাত্রই আমি দীনবন্ধুর মত সূক্ষ্ম শরীরে হাজির হয়ে তাকে সাহায্য করেছিলাম উদ্ভব। তাহলে এবার বল আমার দোষ কোথায় ?”উদ্ভব বলল “আমি বুঝেছি প্রভু। আপনাকে বিস্মরণ করা মানে হল আমার মরণ। তাই প্রভু আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন আমি যেন এক মুহূর্ত আপনাকে না ভুলে যাই।” ভগবান আশীর্বাদ করে বললেন “তথাস্তু”।শ্রী কৃষ্ণ আরও বললেন “উদ্ভব তোমার আর আমার এই কথোপকথন পৃথিবীতে উদ্ভব গীতা নামে অমর হয়ে থাকবে। অমর হয়ে থাকবে তোমার নাম ও”।প্রিয় সখা উদ্ধবকে দেওয়া উপদেশের প্রারম্ভে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন — হে উদ্ধব, তুমি স্বজন বন্ধুদের প্রতি সম্পূর্ন স্নেহ পরিত্যাগ পূর্বক আমাতে সম্যক্ভাবে মনকে আবিষ্ট করে সমদৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে বিচরণ কর।ইন্দ্রিয় সমুদায়কে সংযত করে যোগযুক্তচিত্ত হয়ে এই জগৎকে আত্মাতে (অবিদ্যার দ্বারা) প্রসারিত দেখ। জগদধিষ্ঠান আত্মাকে জগদীশ্বর আমাকে দর্শন কর। অর্থাৎ আত্মাকে ব্রহ্মরুপে অনুভব কর।তত্ত্ববিচারের দ্বারা নিজেকে উদ্ধার করা যায় – এ বিষয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উদ্ধবকে বলছেন – “হে উদ্ধব, এই সংসারে যে মনুষ্য এই জগৎটা কি, এতে কি কি ব্যাপার ঘটছে, কেন ঘটছে, কে ঘটাচ্ছে ইত্যাদি তত্ত্বের বিচার করতে নিপুন, তিনি চিত্তে বাসা বেঁধে থাকা অশুভ বাসনা থেকে নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।সমস্ত প্রানিগনের মধ্যে বিশেষ করে মানুষের অন্তরাত্মাই জীবের হিত এবং অহিতের উপদেশক গুরু। কেননা, মানুষ প্রত্যক্ষ এবং অনুমানের দ্বারা নিজের হিত-অহিতের নির্নয় করতে সর্বতোভাবে সমর্থ। হে উদ্ধব, শরীরধারিগনের মুক্তিকারিনী আত্মবিদ্যা এবং বন্ধনকারিনী অবিদ্যা, এই উভয়ই আমার মায়ার দ্বারা রচিত অনাদিসিদ্ব আমার দুইরুপ।হে মহামতি উদ্ধব, আমার অংশরুপ জীব অনেক নয়, একই। এর অনাদি অবিদ্যার দ্বারা বন্ধন এবং তেমনি বিদ্যার দ্বারা মুক্তি ব্যবহারদৃষ্টিতে স্বীকার করা হয়।অন্ধ বুদ্ধি মনুষ্যেরা এই মনোকল্পিত শরীরকে ‘আমি’ এবং ‘আমার’ মনে করে এই আমি আর এটা অন্য – এইরুপ ভ্রমবশতঃ অনন্ত অজ্ঞান অন্ধকারে ইতস্ততঃ ভ্রমন করতে থাকে। অদ্বিতীয় পরমাত্মা থেকে মায়ার দ্বারা সকল দ্বৈতের উদয়, আবার তাতেই পুনঃ লয় হয়। এইরুপ অনুসন্ধানের দ্বারা ভেদভ্রম নষ্ট হয়। হে প্রিয় উদ্ধব, বস্তুতঃ সংসারের অস্তিত্ব নেই। তবু যতক্ষন পর্যন্ত দেহ, ইন্দ্রিয় এবং প্রানের সঙ্গে আত্মার ভ্রান্তিজনিত সম্বন্ধ আছে, ততদিন অবিবেকী পুরুষের তা সত্যের মত স্ফুরিত হয়।হে উদ্ধব, অহংকারই (দেহে আমিত্ববোধ) শোক, হর্ষ, ভয়, ক্রোধ, লোভ, মোহ, স্পৃহা এবং জন্মমৃত্যুর শিকার হয়। আত্মার সঙ্গে এসবের কোন সম্বন্ধ নেই। হে উদ্ধব, আমাকে লাভ করার যতরকম সাধন আছে, তার মধ্যে আমি মনে করি যে মন, বাণী এবং শরীরের সমস্ত বৃত্তি দ্বারা সমস্ত প্রানীর মধ্যে আমারই ভাবনা করা অর্থাৎ “বাসুদেবঃ সর্বম্” দৃষ্টিতে সবকিছু দেখাই সমীচীন।.হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রের মহিমা অনন্য এবং খুবই শক্তিশালী, কেননা পরমেশ্বর ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এবং হরিনাম এক ও অভিন্ন, কোন পার্থক্য নেই …. হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে.

(সংগৃহীত)