মা কালীর গায়ের রং নীল কেন — একটি দার্শনিক ও ধর্মীয় বিশ্লেষণ

Images

Images

 

হিন্দু ধর্মে মা কালী এক অনন্য দেবী, যিনি সময়, শক্তি, ধ্বংস এবং মাতৃসত্তার প্রতীক। তিনি যেমন ভক্তদের রক্ষা করেন, তেমনি পাপ ও অজ্ঞতার বিনাশও করেন। তাঁর রূপ ভয়ংকর, কিন্তু সেই রূপের অন্তরালে রয়েছে মমতা, করুণা ও জ্ঞানের গভীর বার্তা। মা কালীর রূপের নানা দিকের মধ্যে গায়ের রঙ বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি সাধারণত কালো অথবা গাঢ় নীল রঙে চিত্রিত হন, যা ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক গভীর তাৎপর্য বহন করে।

১. অসীমতা ও মহাশূন্যের প্রতীক

নীল রঙ, বিশেষ করে গাঢ় নীল, ভারতীয় দর্শনে মহাশূন্য বা আকাশের প্রতীক। আকাশ যেমন সীমাহীন, তেমনি মা কালীও অসীম। তাঁর কোনো সীমানা নেই — তিনি জন্ম ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। গাঢ় নীল রঙ এখানে অসীম সময় ও চেতনাবিশ্বের রূপকে প্রকাশ করে, যাকে মানুষ সহজে ধরতে পারে না।

২. অজ্ঞতার গ্রাস ও ধ্বংস

কালো বা নীল রঙ অন্ধকারের প্রতীক, যা জ্ঞানহীনতা বা ‘অবিদ্যা’র চিহ্ন। মা কালী সেই ‘অবিদ্যা’কে আত্মস্থ করেন এবং ধ্বংস করেন। তাই তাঁর রঙ এই প্রতীক — তিনি অন্ধকারের ভেতরে অবস্থান করে সেই অন্ধকারকে শেষ করেন। এই অর্থে, তাঁর গায়ের নীল রঙ ভয়ঙ্কর হলেও তা মুক্তির পথ দেখায়।

৩. তাণ্ডব ও শক্তির প্রতীক

মা কালী তাণ্ডবের রূপে প্রকাশিত হন যখন পৃথিবীতে পাপ বৃদ্ধি পায়। সেই তাণ্ডবী রূপের প্রতিফলন ঘটে তাঁর গায়ের গাঢ় রঙে। নীল বা কালো রং শক্তির প্রতীক — তা গভীর, রহস্যময় এবং এক ধরনের অতীন্দ্রিয় শক্তির বহিঃপ্রকাশ।

৪. আত্ম-নাশ ও পরমতত্ত্বে বিলীন হওয়া

এক দার্শনিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, মা কালী নিজেই ‘মায়া’ বা ভ্রান্তির জাল। তিনি সেই মায়াকে ছিন্ন করেন এবং ভক্তকে সত্যের মুখোমুখি করেন। নীল রঙ এখানে আত্ম-নাশ বা ‘অহং’-এর বিলীন হওয়ার প্রতীক। অর্থাৎ, মা কালী যিনি সব কিছু গ্রাস করেন, তিনিই আবার মুক্তির পথ।

৫. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতীকী ব্যাখ্যা

বাংলা লোকসংস্কৃতিতে কালো বা নীল রঙকে ভয় ও শ্রদ্ধার মিশ্র প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। মা কালীকে এই রঙে কল্পনা করা হয় যেন তিনি সাধারণ মানুষের চিন্তার সীমার বাইরের কোনো শক্তি, যিনি ভালো-মন্দ উভয়ের ঊর্ধ্বে। ফলে, তাঁর রঙ আমাদের অন্তরের ভয়, আশা এবং বিশ্বাসের প্রকাশও বটে।

মা কালীর গায়ের নীল রঙ কোনো সাধারণ রঙ নয় — এটি এক গভীর প্রতীক, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে সময়, শক্তি, ধ্বংস, মুক্তি ও মাতৃত্বের মিশ্র সত্তা। গাঢ় নীল রঙ যেমন আকাশের অসীমতাকে বোঝায়, তেমনি মা কালীও সমস্ত সৃষ্টি, ধ্বংস ও পুনর্জন্মের ঊর্ধ্বে এক চিরন্তন শক্তি। তিনি ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হলেও তাঁর হৃদয় ভক্তের প্রতি পূর্ণ করুণা ও আশীর্বাদে ভরপুর। তাঁর রঙ সেই অন্তর্নিহিত রহস্যকেই বহন করে।

হরিনাম কীর্তন কেন করা হয়?

Images

Images

 

হরিনাম বলতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম (যেমন “হরে কৃষ্ণ, হরে রাম”) বোঝানো হয়। কীর্তন মানে হচ্ছে ভগবানের গুণ, লীলা, নাম, রূপ ইত্যাদির গানে বা উচ্চারণে প্রকাশ। হরিনামের কীর্তন হলো ভগবানের নামের সমবেত গাওয়া বা জপ করা। এখন চলুন ধাপে ধাপে বোঝা যাক কেন হরিনামের কীর্তন করা হয়:

১. আত্মশুদ্ধির জন্য

শাস্ত্র মতে (বিশেষত ভাগবত পুরাণ ও চৈতন্যচরিতামৃত অনুযায়ী), হরিনামের কীর্তনে হৃদয় শুদ্ধ হয়। আমাদের মনে প্রচুর কামনা, ক্রোধ, লোভ ইত্যাদি অশুদ্ধতা থাকে। ভগবানের নাম উচ্চারণ করলে সেই অশুদ্ধতা দূর হয় এবং মন ঈশ্বরের দিকে আকৃষ্ট হয়।

উদ্ধৃতি:
“চেতোদর্পণমার্জনং” — (চৈতন্যচরিতামৃত)
(অর্থ: ভগবানের নাম হৃদয়ের দর্পণকে পরিশুদ্ধ করে।)

২. কলিযুগের জন্য শ্রেষ্ঠ ধর্ম

শাস্ত্রে বলা হয়েছে, কলিযুগে অন্যান্য যোগ বা তপস্যা কঠিন হলেও, হরিনাম সংকীর্তন সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রদ। তাই বলা হয়:

শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ (১২.৩.৫২):
“কলোর দোষনিধে রাজন অস্থি এক মহৎ গুণঃ।
কীর্তনাদেব কৃষ্ণস্য মুক্তঃ সংঘঃ পরং ভজেত্।”
(অর্থ: হে রাজন, যদিও কলিযুগে অনেক দোষ আছে, তবে একটি বড় গুণ হলো—কেবল কৃষ্ণ নাম কীর্তন করলেই মুক্তি লাভ করা যায়।)

৩. ঈশ্বরের সরাসরি উপস্থিতি

শাস্ত্র অনুসারে ভগবান ও ভগবানের নাম অভিন্ন। যখন আমরা হরিনামের কীর্তন করি, তখন প্রকৃতপক্ষে আমরা ভগবানের সান্নিধ্যে থাকি।
“নামচিন্তামণি কৃষ্ণ চৈতন্য রসবিগ্রহঃ” — ভগবান নামের মধ্যে পূর্ণ চেতনা, আনন্দ ও স্বয়ং ভগবানের অস্তিত্ব বর্তমান।

৪. ভক্তি ও প্রেমের বৃদ্ধি

হরিনামের কীর্তন হৃদয়ে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও প্রেম জাগায়। এই প্রেমই জীবের চূড়ান্ত লক্ষ্য (পরমার্থ)। চৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছিলেন —
“হরিনাম কীর্তন করে প্রেম লাভ করা যায়।”

৫. দুঃখ ও সংকট দূর হয়

জীবনের দুঃখ, ক্লেশ, মানসিক অশান্তি ইত্যাদি হরিনামের কীর্তনের দ্বারা দূর হয়। মন প্রশান্ত হয় ও আনন্দে পূর্ণ হয়। এজন্য ভক্তরা বিপদের সময়ও কীর্তন করেন।

৬. বিশ্বশান্তির জন্য

কেবল ব্যক্তিগত মুক্তি নয়, বিশ্বশান্তির জন্যও হরিনাম কীর্তন গুরুত্বপূর্ণ। বহু সাধু-ভক্ত বিশ্বাস করেন, যদি বিশ্ববাসী সম্মিলিতভাবে হরিনাম করে, তবে বিশ্ব থেকে হিংসা, লোভ, যুদ্ধ ইত্যাদি কমে যাবে।

সংক্ষেপে:

হরিনামের কীর্তন করা হয়:

আত্মা শুদ্ধির জন্য।

কলিযুগের সহজ ধর্মপথ হিসেবে।

ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থাকার জন্য।

ভক্তি ও প্রেমের বিকাশের জন্য।

দুঃখ ও কষ্ট মোচনের জন্য।

বিশ্বশান্তির জন্য।

মহামন্ত্র (সবচেয়ে প্রসিদ্ধ)

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র:

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে

 

এই মহামন্ত্রের জপ বা কীর্তন জীবের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং ঈশ্বরপ্রেমের দ্বার খুলে দেয়। চৈতন্য মহাপ্রভু নিজে এই মন্ত্রের প্রচার করেছেন।

এই হরিনাম কীর্তনের কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ বা ব্যাখ্যা আছে কি?

১. ধ্বনি ও কম্পনের প্রভাব

যখন আমরা “হরে কৃষ্ণ” বা অন্য মন্ত্র উচ্চারণ করি, তখন নির্দিষ্ট কম্পন বা ফ্রিকোয়েন্সি সৃষ্টি হয়।

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, ইতিবাচক শব্দ কম্পন (positive vibration) মস্তিষ্কে আনন্দ হরমোন (ডোপামিন, সেরোটোনিন) নিঃসরণ ঘটায়।

মন্ত্রের সুনির্দিষ্ট ছন্দ ও শব্দশক্তি মনকে প্রশান্ত করে এবং স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত করে।

২. সামূহিক কীর্তন ও “সিনক্রোনাইজেশন”

যখন একসাথে অনেক মানুষ এক সুরে কীর্তন করে, তখন সবার মস্তিষ্কের ব্রেনওয়েভ (EEG patterns) একরকম হয়ে যায়। একে বলে নিউরাল সিঙ্ক্রোনাইজেশন।

এর ফলে দলগতভাবে সুখানুভূতি, সংহতি (bonding) এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।

৩. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানো

মন্ত্রোচ্চারণ, বিশেষত সমবেত গানের মাধ্যমে, কর্টিসল (stress hormone) এর মাত্রা কমে যায়।

কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, নিয়মিত কীর্তন বা জপ মানসিক চাপ, উদ্বেগ (anxiety), বিষণ্নতা (depression) ইত্যাদি কমাতে সহায়ক।

৪. শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ

কীর্তন বা মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় শ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে এবং নিয়মিত হয়।

এটা “pranayama” (শ্বাসের যোগব্যায়াম) এর মতো কাজ করে, যা শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা বাড়ায় এবং স্নায়ুকে শান্ত করে।

৫. মস্তিষ্কের গামা-ওয়েভ বৃদ্ধি

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মন্ত্র বা হরিনাম জপ করার সময় মস্তিষ্কের গামা ওয়েভ (৪০ হার্টজ) বৃদ্ধি পায়।

গামা ওয়েভ যুক্ত হয় উচ্চতর সচেতনতা, আনন্দ ও তীব্র মনঃসংযোগের সাথে।

 

সংক্ষেপে:

হরিনাম কীর্তন —

মনের অশান্তি দূর করে।

মানসিক চাপ কমায়।

আত্মবিশ্বাস ও আনন্দ বাড়ায়।

মস্তিষ্ক ও শরীরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে।

মানুষের মধ্যে ঐক্য ও ভালোবাসা তৈরি করে।

গরমকালে কেন হরিনাম করা হয়?

Images

Images

 

গরমকালে হরিনাম কেন করা হয় — এটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিস্তারিতভাবে বললে:

১. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে:

হরিনাম (বিশেষত “হরে কৃষ্ণ হরে রাম” ইত্যাদি) হলো ভগবানের নামস্মরণ। শাস্ত্র মতে কালীযুগে (বর্তমান যুগ) হরিনাম সংকীর্তনই হলো মুক্তির প্রধান উপায়:

বৈষ্ণব ধর্ম (বিশেষত চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রচলিত দর্শন) বলে, গ্রীষ্মকালে, যখন শরীর দুর্বল হয়, মন ক্লান্ত থাকে, তখন ভগবানের নাম জপ বা গাওয়ার মাধ্যমে মন-প্রাণ সতেজ হয়।

গরমকালে মানুষ রোগ-ব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হয়। তাই ঈশ্বরের নামে মন একাগ্র করে রোগ, দুঃখ ও ক্লেশ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করা হয়।

শাস্ত্রের উল্লেখ:
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, পদ্ম পুরাণ ইত্যাদিতে বলা হয়েছে — গ্রীষ্মের তাপদাহে ভগবান নাম-স্মরণ করলে পুণ্য অর্জন হয় এবং পাপ নষ্ট হয়।

২. সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে:

সমষ্টিগত হরিনাম সংকীর্তন (দলের মধ্যে একত্রে গান) মানুষের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। গ্রীষ্মে যখন মানুষ ক্লান্ত ও অস্থির হয়ে পড়ে, তখন এই সম্মিলিত গান একধরনের মানসিক শীতলতা দেয়।

গরমের সময়ে সাংস্কৃতিক মেলা, যাত্রা, হরিনাম যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজে আনন্দ এবং সামাজিক সংযোগ বজায় থাকে।

 

৩. পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে:

আগে গ্রামে গ্রীষ্মকালে হরিনাম করতে করতে গ্রাম পরিক্রমা করা হতো। এতে:

মানুষ ভোরবেলা বা সন্ধ্যায় বের হতো, যা প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করত।

শীতল সময়ে হাঁটাচলা এবং গান করা শরীরের জন্য উপকারী ছিল।

অনেক সময় জল ছিটিয়ে, বৃক্ষরোপণ বা পরিবেশ রক্ষার মন্ত্রও উচ্চারিত হতো হরিনামের সঙ্গে।

 

৪. গ্রীষ্মকালীন ধর্মীয় উৎসবের অংশ:

গরমকালে রথযাত্রা, দোলপূর্ণিমা পরবর্তী সংকীর্তন, নন্দ উৎসব ইত্যাদির সময় ব্যাপক হরিনাম হয়।

এগুলি মূলত কৃষ্ণের নাম-স্মরণকে কেন্দ্র করে হয় এবং ভক্তির মাধ্যমে আত্মিক তৃপ্তি প্রদান করে।

প্রথম অংশ: চৈতন্য মহাপ্রভুর হরিনাম প্রচার ইতিহাস

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬–১৫৩৪ খ্রিঃ) ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে মেনে নেওয়া হয়। তিনি বিশেষ করে হরিনাম-সংকীর্তন আন্দোলন (নাম সংকীর্তন) শুরু করেন, যার মাধ্যমে গোটা সমাজের আধ্যাত্মিক উন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন।

তাঁর হরিনাম প্রচারের মূল বৈশিষ্ট্য:

“হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে” — এই মহামন্ত্রের মাধ্যমে সর্বত্র ভক্তি আন্দোলন ছড়িয়ে দেন।

মহাপ্রভু বিশ্বাস করতেন:
“কলিযুগে কেবল নামসংকীর্তনের মাধ্যমেই মুক্তি সম্ভব”। তাই তিনি সবাইকে গানের ছন্দে ঈশ্বরের নাম জপ করতে উৎসাহ দেন।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত — সব ঋতুতে মহাপ্রভু এবং তাঁর ভক্তগণ নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য প্রভৃতি মিলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হরিনাম প্রচার করতেন।
গরমের সময়ও দিনে-রাতে কীর্তন চলত — বিশেষত সন্ধ্যাবেলা একটু ঠান্ডা হওয়ার সময় বড় বড় শোভাযাত্রা হতো।

কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা:

নদিয়া (নবদ্বীপ) অঞ্চলে তিনি ‘নাগর সংকীর্তন’ চালু করেছিলেন, যেখানে শত শত মানুষ ঢোল, করতাল, মৃদঙ্গ নিয়ে রাস্তায় বের হতেন।

একবার গ্রীষ্মকালে প্রবল গরমের মধ্যেও মহাপ্রভু সমবেত কীর্তনের নেতৃত্ব দেন, এবং লোকজনের মনে গভীর আধ্যাত্মিক আনন্দের সঞ্চার হয়।

মহাপ্রভু বলেছিলেন:
“প্রকৃতির পরিবর্তন যেমন গ্রীষ্ম বা বর্ষা — ভক্তির পথে বাধা নয়; ভগবান নাম গাওয়া সব ঋতুতে সমান জরুরি।”

 

দ্বিতীয় অংশ: শাস্ত্রসম্মত নির্দেশ (Scriptural Instructions)

গ্রীষ্মকালে বিশেষভাবে হরিনাম বা সংকীর্তনের গুরুত্ব বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রে উল্লেখ আছে:

১. ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ:

বলা হয়েছে:
“গ্রীষ্মকালে ভগবানের নাম স্মরণ করে যে ব্যক্তি সংকীর্তন করে, তার পাপ আগুনে দগ্ধ তৃণের মতো ভস্ম হয়।”

২. পদ্ম পুরাণ:

“গ্রীষ্মের তাপদাহে যারা ঈশ্বরের নামগান করে, তারা শুধু নিজেদের নয়, তাদের চারপাশের পরিবেশকেও পবিত্র করে।”

৩. ভগবত পুরাণ (শ্রীমদ্ভাগবতম):

উল্লেখ আছে:
“এই কলিযুগে সংকীর্তন যজ্ঞই প্রধান ধর্ম।”
ঋতু নির্বিশেষে — বিশেষত দুর্যোগপূর্ণ সময়েও — সংকীর্তনই মোক্ষের পথ।

৪. কালীসংক্রান্তি তত্ত্ব:

কিছু প্রাচীন তন্ত্র ও পুরাণ মতে, গ্রীষ্মকাল হচ্ছে শরীর ও চেতনার জন্য চরম পরীক্ষার সময়। এই সময় বিশেষত ঈশ্বরচিন্তন ও নামসংকীর্তন প্রয়োজন, যাতে শরীর-মন ভারসাম্য বজায় থাকে।

সংক্ষেপে:

গরমকালে হরিনাম করা হয় কারণ এটি শরীর, মন এবং আত্মার প্রশান্তি দেয়, রোগ ও পাপ থেকে মুক্তি দেয়, সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষা করে এবং পরিবেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সাহায্য করে। ধর্মীয়ভাবে, এটি কলিযুগের শ্রেষ্ঠ সাধনাও বটে।

এবার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করি — গরমকালে হরিনাম বা সমবেত সংগীতচর্চার উপকারিতা কীভাবে কাজ করে:

১. মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব (Psychological effects)

সংগীত (বিশেষত সমবেত গান বা সংকীর্তন) ডোপামিন, সেরোটোনিন ও এন্ডরফিন (সুখের হরমোন) নিঃসরণ বাড়ায়।

গ্রীষ্মে প্রচণ্ড তাপের কারণে মস্তিষ্কে স্ট্রেস হরমোন (কর্টিসল) বেড়ে যায়, ক্লান্তি ও অস্থিরতা বাড়ে। সমবেত হরিনাম করার সময় কর্টিসল কমে যায়, ফলে মন শান্ত ও প্রশান্ত হয়।

নিয়মিত জপ বা গান করলে মনোযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং উদ্বেগ কমে।

 

২. শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রভাব (Respiratory and Nervous system)

হরিনাম করার সময় দীর্ঘশ্বাস এবং ছন্দময় উচ্চারণের কারণে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ে।

ধীর লয়ে, সংগীতময় উচ্চারণে প্যারাসিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম (শরীরের বিশ্রাম ও হিলিং সিস্টেম) সক্রিয় হয়, ফলে রক্তচাপ কমে এবং হৃদস্পন্দন নিয়মিত হয়।

গরমের সময় এই ধরণের শ্বাসপ্রশ্বাস পদ্ধতি শরীরকে দ্রুত ঠান্ডা করতে সাহায্য করে।

 

৩. শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ (Thermal Regulation)

হরিনাম বা সংকীর্তনের সময় মৃদু শারীরিক চলাচল (পদক্ষেপ নেওয়া, মাথা দোলানো ইত্যাদি) হয়।

এভাবে ঘর্মনিঃসরণ (Sweating) নিয়ন্ত্রিত হয়, যা দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে।

অতিরিক্ত গরমে দীর্ঘ সময় নীরব বা স্থির থাকলে হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে; হালকা সক্রিয়তা এই ঝুঁকি কমায়।

 

৪. সমষ্টিগত ক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক উপকারিতা (Collective Behavior Benefits)

যখন মানুষ দলবদ্ধভাবে হরিনাম করে, তখন Social Bonding Hormone (Oxytocin) নিঃসৃত হয়।
এটি:

মানুষকে একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল করে,

একাকীত্ব এবং বিষণ্ণতা দূর করে।

গরমকালে মানসিক দুশ্চিন্তা এবং বিরক্তি বেশি হয়; এই সমবেত গানের মাধ্যমে তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে।

 

৫. স্মৃতিশক্তি এবং মস্তিষ্কের উন্নতি (Cognitive Enhancement)

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে: নিয়মিত মন্ত্রোচ্চারণ বা সঙ্গীতচর্চা করলে হিপোক্যাম্পাস (স্মৃতির কেন্দ্রীয় অংশ) সক্রিয় হয়।

ফলে গ্রীষ্মকালের ক্লান্তি বা ‘ব্রেন ফগ’ দূর হয় এবং মানসিক সতেজতা বজায় থাকে।

 

সংক্ষেপে বৈজ্ঞানিক ভাষায়:

হরিনাম সংকীর্তন গরমকালে স্ট্রেস কমিয়ে, শ্বাসপ্রশ্বাস উন্নত করে, দেহের উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে।