#স্বামী পরমানন্দ এর জীবনী (তৃতীয় পর্ব)

 

 

সুরেশচন্দ্র যখন মঠে আসিয়া যোগ দিলেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ষোল বৎসর ৷ এত ছোট ছেলেকে মঠে যোগদান করিতে দেওয়া সমীচীন হইবে কিনা, ইহা লইয়া মঠের সাধুরা একটু সমস্যায় পড়িয়াছিলেন ৷ বালক সুরেশচন্দ্রও ইহাতে বড়ই নিরাশ হইয়া, মঠে প্রথম রাত্রি বিনিদ্র যাপন করিলেন ৷ মন তাঁহার দুঃখে ও অভিমানে ভারাক্রান্ত হইয়াছিল ৷ অবশেষে তাঁহার বালক বয়সই তাঁহাকে জীবনের পরমবাঞ্ছিত পথে চলিতে বাধা সৃষ্টি করিবে !

 

যাহা হউক, দুশ্চিন্তার নিশা অবসান হইলে, মলিনমুখে তিনি অপেক্ষায় বসিয়া থাকিলেন ৷ মনে মনে শ্রীভগবানের কাছে কাতরে জানাইতেছিলেন — “হে ঠাকুর তোমার অভয় আশ্রয়ে একটু স্থান দাও ৷ আমি ছোট বলিয়াই কি তোমার চরণে ঠাঁই পাইব না ? তুমি কি শুধু বড়দের জন্য, ছোটদের জন্য নও ?”

 

এমন সময়ে সহসা স্বামীজী তাঁহাকে ডাক দিলেন — “হ্যাঁরে, তুই গান গাইতে জানিস ? গা তো একটা গান ৷” সুরেশের বুক হইতে যেন পাষাণভার খসিয়া পড়িল ৷ স্বামীজীর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিয়াই, প্রাণ ঢালিয়া গান ধরিলেন —

 

“চিনি না জানি না বুঝি না তাঁহারে, তথাপি তাঁহারে চাই ৷

(আমি) সজ্ঞানে অজ্ঞানে পরানের টানে, তাঁর পানে ছুটে যাই ৷৷

দিগন্ত প্রসার অনন্ত আঁধার, আর কোথা কিছু নাই ৷

(আমি) তাহার ভিতরে মৃদু মধুস্বরে কে ডাকে শুনিতে পাই ৷৷

আঁধারে নামিয়া আঁধার ঠেলিয়া না বুঝিয়া চলি তাই ৷

আছেন জননী, এই মাত্র জানি, আর কোন জ্ঞান নাই ৷৷

কিবা তাঁর নাম, কোথা তাঁর ধাম, কে জানে কারে শুধাই ৷

না জানি সন্ধান, যোগ ধ্যান জ্ঞান, ঘ্রাণে মত্ত হয়ে ধাই ৷৷”

 

স্বামীজী অদ্ভুত এক কৌশলে সুরেশের মনের কথাগুলি জানিয়া লইয়াছিলেন ৷ হৃদয়ের সবটুকু ভাবের সহিত চোখের জল মিশাইয়া সুরেশও স্বামীজীর কাছে এইভাবেই তাঁহার প্রাণের কথা নিবেদন করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন ৷ স্বামীজী বালকের আর্তিতে প্রসন্ন হইয়া, তাঁহাকে মঠে থাকিবার অনুমতি প্রদান করিলেন এবং গুরুভ্রাতাদের ডাকিয়া তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিলেন, “এই ছেলেটি মঠে থাকবে ৷”

 

স্বামীজীর অনুমতি হওয়াতে, অন্যান্য সকলেই নিশ্চিন্ত হইয়া, বালক সুরেশকে পরম-স্নেহভরে মঠে থাকিবার ব্যবস্থাদি সব করিয়া দিলেন ৷ স্বামীজীর পদপ্রান্তে স্থান পাইয়া, সুরেশও সেই দিন হইতে নূতন জীবন লাভ করিলেন ৷ উদ্বেগ-সমস্যা ও ভাবনা-চিন্তার অবসান হওয়াতে বালকের মুখে চোখে অদ্ভুত এক মাধুর্য ফুটিয়া উঠিয়াছিল ৷ মনে হইতেছিল, শীতের জড়তাশেষে সদ্যসমাগত বসন্ত-ঋতুর মলয়-স্পর্শে তাঁহাতে যেন নবীন প্রাণের সঞ্চার হইয়াছে ৷ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাই তাঁহাকে আদর করিয়া নাম দিলেন ‘বসন্ত’ ৷

 

এই নামকরণের পশ্চাতে সুরেশের প্রতি মহারাজের একটি স্নেহাশীর্বাদও প্রচ্ছন্ন ছিল ৷ ব্রহ্মানন্দজী বলিতেন, “শঙ্কর কি বলেছেন জানিস তো ? তিনি বলেছেন, ‘শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো, বসন্ত-বল্লোকহিতং চরন্তঃ ৷’ ‘শান্ত মহান সাধুব্যক্তিরা সংসারে থেকে বসন্তঋতুর মতো লোককল্যাণে নিরত থাকেন — তাঁরা যেখানে যান, সেখানেই বসন্তসমাগমের আনন্দ’ ৷”

( চলবে )

  1. ((সংগৃহীত)) PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.

#স্বামী পরমানন্দ এর জীবনী (দ্বিতীয় পর্ব)

 

 

সুরেশচন্দ্রের গৃহে দেবসেবা ছিল ৷ পিতার ধর্মানুরাগ ও পরহিতাকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি সদগুণ সুরেশের মধ্যেও শৈশবকাল হইতে সংক্রমিত ছিল ৷ তাঁহাদের স্বগ্রামে বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতে এবং আরও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁহার পিতা পল্লীর মধ্যে একজন অগ্রণী পুরুষ ছিলেন ৷ ইঁহারা কিছুকাল কলিকাতায় এবং পরে ঢাকায় বসবাস করেন ৷

সুরেশচন্দ্র শৈশব হইতেই তীক্ষ্ণধী ছিলেন, কিন্তু বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পাঠ্যবিষয়ের প্রতি আদৌ তিনি মনোযোগী ছিলেন না ৷ খেলাধুলা, শরীরচর্চা এবং বালকোচিত চপলতা ও দুরন্তপনাতেই তাঁহার দিন কাটিয়া যাইত ৷ গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, ইত্যাদিতে তাঁহার বন্ধুদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম ৷ একবার ফুটবল খেলার শেষে, বাড়ি ফিরিবার পথে একটি বিষাক্ত সাপ দেখিয়া, অন্যান্য বালকেরা যখন ভয়ে চীৎকার করিতেছিল, সুরেশ তখন পরম আহ্লাদে জীবন্ত সাপটিকে লেজে ধরিয়া ঘুরাইতে ঘুরাইতে মৃতপ্রায় করিয়া দূরে বাগানের মধ্যে ছুঁড়িয়া দিয়াছিলেন ৷ অভয় ও বিনয় এবং পৌরুষ ও মাধুর্য তাঁহার মধ্যে সমভাবেই প্রকাশিত ছিল ৷

বৃদ্ধ পিতাকে সুরেশ ধর্মগ্রন্থাদি পাঠ করিয়া শুনাইতেন ৷ বালকের কণ্ঠও ছিল মিষ্ট ৷ তাই পিতাকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় ভজন গাহিয়া শোনানোও তাঁহার একটি নিত্যকর্তব্য ছিল ৷ পিতাকে শোনাইবার জন্য ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ’ তাঁহাকে পড়িতেই হইত ৷ উহাতে শ্রীরামকৃষ্ণ-উদাহৃত ‘সূর্যোদয়ের আগে তোলা মাখন’ কথাটি বালক সুরেশের মনে গভীর রেখাঙ্কন করিয়াছিল ৷ রোজই পিতার কাছে বসিয়া, শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রসঙ্গ পড়িতে পড়িতে বালকের মনে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা দানা বাঁধিতে থাকে ৷ এই কালে স্বামী নিত্যানন্দ নামে স্বামীজীর একজন সন্ন্যাসী শিষ্যের সংস্পর্শেও বালক সুরেশের মনে জগতের অনিত্যতাবোধ আনয়ন করিতে অনেকখানি সহায়ক হইয়াছিল ৷ একটি স্বপ্ন-দর্শনের স্মৃতিও নাকি তাঁহাকে এইকালে খুব ত্যাগের পথে প্রেরণা দিয়াছিল ৷

  • যাহা হউক, বালক সুরেশ একদিন সংসার ত্যাগের জন্য পিতার নিকট অনুমতি চাহিলেন ৷ বৃদ্ধ পিতা তো ইহা শুনিয়াই সুরেশকে প্রথমে খুব তিরস্কার করিলেন, পরে অনেক করিয়া বুঝাইয়া সংসারে ফিরাইবার জন্য বারবার চেষ্টা করেন ৷ কিন্তু ফল কিছুই হয় নাই ৷ ১৯০০ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের কোন সময়ে এক গভীর রাত্রিতে সুরেশ সকলের অজ্ঞাতসারে, গৃহত্যাগ করিয়া চলিয়া যান ৷ সুরেশ খুঁজিয়া খুঁজিয়া অবশেষে বেলুড় মঠেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন ৷
    ( চলবে )

((সংগৃহীত)) PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.