সুরেশচন্দ্র যখন মঠে আসিয়া যোগ দিলেন, তখন তাঁহার বয়স মাত্র ষোল বৎসর ৷ এত ছোট ছেলেকে মঠে যোগদান করিতে দেওয়া সমীচীন হইবে কিনা, ইহা লইয়া মঠের সাধুরা একটু সমস্যায় পড়িয়াছিলেন ৷ বালক সুরেশচন্দ্রও ইহাতে বড়ই নিরাশ হইয়া, মঠে প্রথম রাত্রি বিনিদ্র যাপন করিলেন ৷ মন তাঁহার দুঃখে ও অভিমানে ভারাক্রান্ত হইয়াছিল ৷ অবশেষে তাঁহার বালক বয়সই তাঁহাকে জীবনের পরমবাঞ্ছিত পথে চলিতে বাধা সৃষ্টি করিবে !
যাহা হউক, দুশ্চিন্তার নিশা অবসান হইলে, মলিনমুখে তিনি অপেক্ষায় বসিয়া থাকিলেন ৷ মনে মনে শ্রীভগবানের কাছে কাতরে জানাইতেছিলেন — “হে ঠাকুর তোমার অভয় আশ্রয়ে একটু স্থান দাও ৷ আমি ছোট বলিয়াই কি তোমার চরণে ঠাঁই পাইব না ? তুমি কি শুধু বড়দের জন্য, ছোটদের জন্য নও ?”
এমন সময়ে সহসা স্বামীজী তাঁহাকে ডাক দিলেন — “হ্যাঁরে, তুই গান গাইতে জানিস ? গা তো একটা গান ৷” সুরেশের বুক হইতে যেন পাষাণভার খসিয়া পড়িল ৷ স্বামীজীর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিয়াই, প্রাণ ঢালিয়া গান ধরিলেন —
“চিনি না জানি না বুঝি না তাঁহারে, তথাপি তাঁহারে চাই ৷
(আমি) সজ্ঞানে অজ্ঞানে পরানের টানে, তাঁর পানে ছুটে যাই ৷৷
দিগন্ত প্রসার অনন্ত আঁধার, আর কোথা কিছু নাই ৷
(আমি) তাহার ভিতরে মৃদু মধুস্বরে কে ডাকে শুনিতে পাই ৷৷
আঁধারে নামিয়া আঁধার ঠেলিয়া না বুঝিয়া চলি তাই ৷
আছেন জননী, এই মাত্র জানি, আর কোন জ্ঞান নাই ৷৷
কিবা তাঁর নাম, কোথা তাঁর ধাম, কে জানে কারে শুধাই ৷
না জানি সন্ধান, যোগ ধ্যান জ্ঞান, ঘ্রাণে মত্ত হয়ে ধাই ৷৷”
স্বামীজী অদ্ভুত এক কৌশলে সুরেশের মনের কথাগুলি জানিয়া লইয়াছিলেন ৷ হৃদয়ের সবটুকু ভাবের সহিত চোখের জল মিশাইয়া সুরেশও স্বামীজীর কাছে এইভাবেই তাঁহার প্রাণের কথা নিবেদন করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন ৷ স্বামীজী বালকের আর্তিতে প্রসন্ন হইয়া, তাঁহাকে মঠে থাকিবার অনুমতি প্রদান করিলেন এবং গুরুভ্রাতাদের ডাকিয়া তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিলেন, “এই ছেলেটি মঠে থাকবে ৷”
স্বামীজীর অনুমতি হওয়াতে, অন্যান্য সকলেই নিশ্চিন্ত হইয়া, বালক সুরেশকে পরম-স্নেহভরে মঠে থাকিবার ব্যবস্থাদি সব করিয়া দিলেন ৷ স্বামীজীর পদপ্রান্তে স্থান পাইয়া, সুরেশও সেই দিন হইতে নূতন জীবন লাভ করিলেন ৷ উদ্বেগ-সমস্যা ও ভাবনা-চিন্তার অবসান হওয়াতে বালকের মুখে চোখে অদ্ভুত এক মাধুর্য ফুটিয়া উঠিয়াছিল ৷ মনে হইতেছিল, শীতের জড়তাশেষে সদ্যসমাগত বসন্ত-ঋতুর মলয়-স্পর্শে তাঁহাতে যেন নবীন প্রাণের সঞ্চার হইয়াছে ৷ স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাই তাঁহাকে আদর করিয়া নাম দিলেন ‘বসন্ত’ ৷
এই নামকরণের পশ্চাতে সুরেশের প্রতি মহারাজের একটি স্নেহাশীর্বাদও প্রচ্ছন্ন ছিল ৷ ব্রহ্মানন্দজী বলিতেন, “শঙ্কর কি বলেছেন জানিস তো ? তিনি বলেছেন, ‘শান্তা মহান্তো নিবসন্তি সন্তো, বসন্ত-বল্লোকহিতং চরন্তঃ ৷’ ‘শান্ত মহান সাধুব্যক্তিরা সংসারে থেকে বসন্তঋতুর মতো লোককল্যাণে নিরত থাকেন — তাঁরা যেখানে যান, সেখানেই বসন্তসমাগমের আনন্দ’ ৷”
( চলবে )
- ((সংগৃহীত)) PUBLISHED BY SHRUTI ADHYA KUNDU MARKETING OFFICER OF SYCN.