তোতাপুরী জগদম্বাকে মানে না। কিন্তু তোতাপুরীর ওপর জগদম্বারর অপার করুণা। করুণাবলেই তার সাধনার পথ সহজ করে দিয়েছেন। দেখাননি তাকে তাঁর রঙ্গিণী মায়ার খেলা। অবিদ্যারূপিনী মোহিনী মায়ার ইন্দ্রজাল। দেখাননি তাকে তাঁর সর্বগ্রাসিনী করালী মূর্তি। প্রকটিতবদনা বিভীষিকা। বরং তাকে দিয়েছেন সুদৃঢ় স্বাস্থ্য, সরল মন আর বিশুদ্ধ সংস্কার। তাই নিজের পুরুষাকারের প্রয়োগে সহজ পথে উঠে গিয়েছে। আত্মজ্ঞানে, ঈশ্বরদর্শনে, নির্বিকল্প সমাধিভূমিতে। এখন মহামায়া ভাবলেন, ওকে এবার বোঝাই আসল অবস্থাটা কি।
লোহার মত শরীর, লোহা চিবিয়ে হজম করতে পারে তোতাপুরী — হঠাৎ তার রক্তআমাশা হয়ে গেল।
সব সময় পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। কি করে মন আর ধ্যানে বসে। ব্রহ্ম ছেড়ে মন এখন শুধু শরীরে লেগে থাকে। মনের সেই শান্তির মৌন চলে গিয়ে দেখা দেয় শারীরিক আর্তনাদ।
ব্রহ্ম এবার পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়েছেন। এবার মহামায়ার কৃপা না হলে আর রক্ষা নেই।
তোতাপুরী ভাবলে এবার পালাই বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু শরীর ভাল থাকছে না এই অজুহাতে পালিয়ে যাব ? হাড়-মাসের খাঁচা এই শরীর। তাকে এত প্রাধান্য দেব ? তার জন্য ছেড়ে যাব এই ঈশ্বরসঙ্গ ? যেখানে যাব সেখানেই তো শরীর যাবে। শরীরের সঙ্গে-সঙ্গে রোগও যাবে। শরীর যখন আছে, তখন তো তা ভুগতেই হবে। শেষও হয়ে যাবে একদিন। সেই শরীরের প্রতি মমতা কেন ? যাক্ না তা ধুলোয় নস্যাৎ হয়ে। ক্ষয়হীন আত্মা রয়েছে অনির্বাণ। রোগ, জরা, মৃত্যু তাকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না। সে প্রদীপ্ত চৈতন্য শরীর-বহির্ভূত।
নানা তর্ক করে মনকে স্তব্ধ করল তোতাপুরী।
কিন্তু রোগ না শোনে ধর্মের কাহিনী। ক্রমেই তার শিখা বিস্তার করতে লাগল— যন্ত্রণার শিখা। ঠিক করল, আর থাকা চলে না দক্ষিণেশ্বরে — রামকৃষ্ণের থেকে শেষে বিদায় নিতেই হবে। কিন্তু মুখ ফুটে রামকৃষ্ণকে তা বলে এমন সাধ্য নেই। কে যেন তার মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে কথা কইতে বাধা দিচ্ছে। আজ থাক, কাল বলব। বারে-বারে এইভাব এসে তাকে নিরস্ত করছে। আজ গেল, কালও সে পঞ্চবটীতে বসে রামকৃষ্ণের সঙ্গে বেদান্ত নিয়েই আলোচনা করলে। অসুখের কথা দন্তস্ফুট করতে পারল না।
একদিন রাতে শুয়েছে, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হল। উঠে বসল তোতাপুরী। এ যন্ত্রণার কিসে নিবারণ হবে ? মনকে দেহ থেকে বিছিন্ন করে পাঠাতে চাইল সেই অদ্বৈতভূমিতে। কিন্তু মন আর যেতে চায় না। একটু ওঠে আবার পেটের যন্ত্রণায়য় নেমে পড়ে। শরীরবোধের আর বিচ্যুতি ঘটে না। ভীষয়ণ বিরক্ত হল তোতাপুরী। যে অপদার্থ শরীরটার জন্য মনকে বশে আনতে পারছি না, সে শরীর রেখে লাভ কি ? তার জন্য কেন এত নির্যাতন ? সেটাকে বিসর্জন দিয়ে মুক্ত, শুদ্ধ, অসঙ্গ হয়ে যাই।
তোতাপুরী ঠিক করল ভরা গঙ্গায়য় ডুবে মরবে।
গঙ্গার ঘাটে চলে এল তোতা। সিঁড়ি পেরিয়ে ধীরে-ধীরে জলে নামতে লাগল। ক্রমে-ক্রমে এগুতে লাগল গভীরের দিকে, মাঝ নদীতে।
কিন্তু এ কি! গঙ্গা কি আজ শুকিয়ে গেছে ? আদ্ধেক প্রায় হেঁটে চলে এল, তবু এখনো কি না ডুব-জল পেল না ? এ কি গঙ্গা ? না একটা শিশে খাল ? প্রায় ওপারের কাছাকাছি এসে পড়ল, এখন কি না ফের হাঁটু-জলে এসে ঠেকেছে। এ কি পরমাশ্চর্য ! ডুবে মরার জল পর্যন্ত আজ গঙ্গায় নেই ?
“এ ক্যায়া দেবী মায়া” অসহায়ের মত চিৎকার করে উঠল তোতাপুরী।
হঠাৎ তার চোখের ঠুলি যেন খসে পড়ল। যে অব্যয়-অদ্বৈত ব্রহ্মকে সে ধ্যান করে এসেছে, তাকে সে এখন দেখলে মায়ারূপিনী শক্তিরূপে। যা ব্রহ্ম, তাই ব্রহ্মশক্তি। ব্রহ্ম নির্লিপ্ত কিন্তু শক্তিতেই জীব-জগৎ। ব্রহ্ম নিত্য, শক্তি লীলা। যেমন সাপ আর তির্যক গতি, যেমন মণি আর বিভা।
সেই বিভাবতী জ্যোতির্ময়ীকে দেখল এখন তোতাপুরী। দেখল “জগজ্জননী” সমস্ত চরাচর আবৃত করে রেখেছেন। যা কিছু দৃশ্য, দর্শন ও দ্রষ্টা সব তিনি। শরীর-মন রোগ-স্বাস্থ্য জ্ঞান-অজ্ঞান জীবন-মৃত্যু — সব তাঁর রূপছটা। ” একৈব সা মহাশক্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্।”
মা’র এই বিশ্বব্যপ্ত রূপ দেখে তোতা অভিভূত হয়ে গেল।
লুপ্ত হয়ে গেল ব্যাধিবোধ। নদী ভেঙে সে ফের ফিরে চলল দক্ষিণেশ্বরে।
পঞ্চবটীতে ধুনির ধারে বসল গিয়ে সে চুপচাপ। ধ্যানে চোখ বোজে আর দেখে সে জগদম্বাকে। চিৎসত্তাস্বরূপিনী পরমানন্দময়ীকে।
সকালবেলা তোতাকে দেখে রামকৃষ্ণ তো অবাক। শরীরে রোগের আভাস-লেশ নেই। সর্বত্র প্রহর্ষ প্রকাশ।
“এ কি হল তোমার ? কেমন আছ ?”
“রোগ সেরে গেছে।”
“সেরে গেছে ? কি করে ?”
“কাল তোমার মা’কে দেখেছি।” তোতার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
“আমার মা’কে ?”
“হ্যাঁ, আমারো মা’কে। জগতের মা’কে। সর্বত্র তাঁর আত্মলীলার স্ফুর্তি— চিদৈশ্বর্যের বিস্তার—-“
“কেমন বলেছিলাম না ?” রামকৃষ্ণ উল্লাসিত হয়ে উঠল। “তখন না বলেছিলে আমার কথা সব ভ্রান্তি ? তোমায় কি বলব, আমার মা’যে ভ্রান্তিররূপেও সংস্থিতা —-“
“দেখলাম যা ব্রহ্ম, তাই ই শক্তি। যা অগ্নি, তাই দাহিকা। যা প্রদীপ, তাই প্রভা। যা বিন্দু, তাই সিন্ধু। ক্রিয়াহীনে ব্রহ্মবাচ্য, ক্রিয়াযুক্তেই মহামায়া।”
“দেখলে তো, দেখলে তো ?” রামকৃষ্ণের খুশী আর ধরে না। আমার মা’কে না দেখে কি তুমি যেতে পারো ? যোগে বসে এত দেখেছ, আর আমার মহাযোগিনী মা’কে দেখবে না ?”
যা মন্ত্র, তাই মূর্তি। এক বিন্দু বীর্য থেকে এই অপূর্বসুন্দর দেহ, এক ক্ষুদ্র বীজ থেকে বৃহৎ বনস্পতি, এক তুচ্ছ স্ফুলিঙ্গ থেকে বিস্তীর্ণ দাবানল। তেমনি ব্রহ্ম থেকে এই শক্তির আত্মলীলা।”
“এবার তোমার মা’কে বলে আমার ছুটি পাইয়ে দাও।”
“আমি কেন ? তোমার মা তুমি বলো না।” হাসতে লাগল রামকৃষ্ণ।
তোতা চলে এল ভবতারিণীর মন্দিরে। সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল মা’ কে। প্রসন্ন মনে মা তাকে যাবার অনুমতি দিলেন। রামকৃষ্ণকে বিদায় জানিয়ে কালীবাড়ি ছেড়ে চলে গেল কোন দিকে।
কোন দিকে গেল কেউ জানে না।
পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ
লেখক – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
.
(সংগৃহীত)